দারিদ্র্যের অর্থনীতি অতীত বর্তমান ভবিষ্যত

দারিদ্র্যের অর্থনীতি অতীত বর্তমান ভবিষ্যত

আকবর আলি খান


দেশে দুর্ভিক্ষ লাগলো। রাজা মন্ত্রীদের আদেশ দিলেন অর্থনীতিবিদদের সাথে পরামর্শ করতে। অর্থনীতিবিদগণ তাদের চিরাচরিত স্বভাব ও নীতি অনুযায়ী সমান দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেলেন। এক দল নৈরাশ্যবাদী, আরেকদল আশাবাদী। রাজা মন্ত্রীকে বললেন, আশাবাদীদের কথা আগে শুনি। আশাবাদী অর্থনীতিবিদগণ বললেন, দেশে যে পরিমাণ খাদ্য মজুদ আছে তা যদি সমানভাবে বণ্টিত হয় তাহলে দেশের লোক এক বেলা ভাত এবং এক বেলা ঘাস খেয়ে থাকতে পারবে। রাজা হতভম্ব হয়ে গিয়ে বললেন, এবার নৈরাশ্যবাদীদের বক্তব্য শুনি। নৈরাশ্যবাদীরা বললেন, দেশের লোকের খাওয়ানোর মত পর্যাপ্ত খাবারও নেই, ঘাসও নেই। 



অষ্টাদশ শতকের আগে অর্থনীতিবিদেরা ছিলেন মূলত হতাশাবাদী। তারা মনে করতেন পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব নয়। অষ্টাদশ শতকের অর্থনীতিবিদ ম্যালথাস এবং রিকার্ডো প্রমুখ ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদের নাম আমরা শুনেছি। এঁরা ছিলেন পেসিমিস্ট অর্থনীতিবিদ। এঁরা মনে করতেন, শ্রমিকদের পারিশ্রমিক বৃদ্ধি পেলে শ্রমিকরা বেশি করে সন্তান নেবে ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে শ্রমিকের যোগান বৃদ্ধি পাবে এবং আবার শ্রমিকের পারিশ্রমিক কমে যাবে। তাঁদের ধারণা ছিল সরকার নিরাপত্তা বেষ্টনীর নামে দরিদ্র জনগণের মধ্যে অর্থ সহায়তা দিলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই জনগণকে অর্থ সহায়তা দেয়া যাবে না। 


হতাশাবাদী অর্থনীতিবিদদের মত ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত মানুষের ধারণা ছিল দারিদ্র্য সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দারিদ্র্য নির্মূল করা সম্ভব নয়। পৃথিবীতে বেশিরভাগ ধর্মে ইহজাগতিক দারিদ্র্যের ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরকালে পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে। শুনতে কিছুটা অদ্ভুত শোনালেও অতীতে অনেকে দরিদ্র থাকাকে সম্মানও মনে করেছে। 


ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর অর্থনীতিবিদগণ দারিদ্র্যকে নির্মূল করা সম্ভব এমন আশার কথা বলেছেন। 


গত একশো বছরে পৃথিবী থেকে সহনশীল এবং হত  দারিদ্র্য উভয়ই কমেছে। অতীতে রাজা-বাদশাদের আমলে পৃথিবীর নব্বই শতাংশ লোক ছিল চরম দরিদ্র, পাঁচ শতাংশ লোক ছিল দরিদ্র এবং পাঁচ শতাংশ লোক ছিল স্বচ্ছল। ১৯৯০ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন অনুযায়ী পৃথিবীতে হত দরিদ্রের হার ৩৫.৬%, বর্তমানে তা ১০.১% এ নেমে এসেছে। ১৯৯০ সালে পৃথিবীতে সহনীয় দরিদ্র ছিল ৫৫% এবং বর্তমানে তা ২৬% নেমে এসেছে। পৃথিবী থেকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমছে। অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে পৃথিবীতে বর্তমানে স্বচ্ছল লোকের সংখ্যা বেশি। তবে, একই সাথে এটাও সত্য পৃথিবীতে ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে যেকোনো সময়ের মোট জনসংখ্যার চেয়ে এখন দরিদ্র লোকের সংখ্যা বেশি। এমনকি ১৯০০ সালে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার চেয়ে বর্তমানে ক্ষুধার্ত লোকের সংখ্যা বেশি। তবে, আশার কথা হলো, পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যের হার দ্রূত কমছে। ড. মোহাম্মদ ইউনুস যেমন বলেছেন, তিনি দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাবেন। উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, জোসেফ স্টিগলিজ, অভিজিৎ ব্যানার্জি প্রমুখেরা স্বপ্ন দেখাচ্ছেন আগামীর বিশ্ব দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব হবে।


তবে, একই সাথে দারিদ্র্যের সংজ্ঞাতেও পরিবর্তন এসেছে। এখন শুধু খাবার অপ্রাপ্তিকেই দারিদ্র্য হিসেবে ধরা হয় না, কিলোক্যালরি হিসেব করা হয়। আবার জীবনযাত্রার সাথে জড়িত অন্যান্য বিষয় হিসেবে করা হয়। যেমন, মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার কিংবা আরও পরে মাথাপিছু ইন্টারনেট ব্যবহার প্রভৃতি দারিদ্রের বিষয়বস্তুর সাথে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। 


বইটি পনেরটি অধ্যায়ে মোট পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত। 


বইটি পড়লে জানতে পারবেন দারিদ্র্যের সংজ্ঞা, দারিদ্র্য বিষয়ে বিভিন্ন ধর্মে এবং পৌরাণিক কাহিনীতে কী বলা হয়েছে। ছোট পরিসরে দুর্ভিক্ষের ইতিহাস পাবেন। বর্তমান উন্নয়ন অর্থনীতিবিদদের দারিদ্র্য বিষয়ে ধারণা পাবেন। দারিদ্র্য রেখা কী জানতে পারবেন। বাংলাদেশ দারিদ্র্য নির্মূলে কতটা এগোলে, কতটা দারিদ্র্যমুক্ত হলো, ভবিষ্যতে আরও কতটা কমতে পারে জানতে পারবেন। দারিদ্র্য নির্মূলে এনজিওর ভূমিকা, ড. মোহাম্মদ ইউনূসের ভূমিকা, ড. ফজলে হাসান আবেদের ভূমিকা, ইসলামী ব্যাংকের ভূমিকা জানতে পারবেন। জানতে পারবেন সুদের ইতিহাস, বিভিন্ন বইয়ে এবং ধর্মে সুদ সম্পর্কে যে ধারণা দেয়া আছে সেটা সম্পর্কে ধারণা পাবেন। ইসলামী ব্যাংক কতটা সুদমুক্ত ব্যাংক তার একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা আছে বইটিতে। 


আকবর আলি খানের বইয়ের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তিনি প্রচুর ডেটা সন্নিবেশ করেন এবং সেগুলোর ব্যাপক এনালাইসিস করেন। তাঁর বই পড়লে একইসাথে বিভিন্ন ডেটার সাথে যেমন পরিচিত হওয়া যায়, অন্যদিকে ডেটা এনালাইসিসটা শেখা যায়। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা হলো তিনি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সাহায্য করেন।



Post a Comment

0 Comments