পৃথিবীর পথে পথে

পৃথিবীর পথে পথে


 ২০১১ কি ১২'র কোনো এক গভীর রাত হবে। সচলায়তনে "আমার দেখা কিউবা" শিরোনামে ভ্রমণকাহিনীটি নজরে পড়ে। লেখাটি পড়ে, আমার মনে আছে, রুমমেটদের সাথে গল্প করেছিলাম। এবং শেষ পর্যন্ত গল্পটা সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদ তর্ক দিয়ে শেষ হতে হতে সকাল হয়ে গিয়েছিল। পরিব্রাজক তারেক অণুকে তখন থেকে চিনি। 



সচলায়তনের আরেকজন ব্লগার চরম উদাস তাঁর "এসো নিজে করি" বইয়ে ভ্রমণকারীর কী করা উচিত কী করা উচিত নয় এমন গাইডলাইন দিতে গিয়ে তারেক অণুর স্মরণ করেছেন। তাছাড়া, প্রয়াত বিজ্ঞান লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ের "ভিক্টরিয়া ওকাম্পো: এক রবি বিদেশিনীর খোঁজে" বইয়ে তারেক অণুর ঋণ স্বীকার করেছেন। এমনকি জনপ্রিয় লেখক শাহাদুজ্জামান "আধো ঘুমে ক্যাস্ত্রোর সাথে" কল্পিত সাক্ষাৎকারের বইয়েও তারেক অণুর নাম নিয়েছেন। তাই তারেক অণু আমার কাছে বহুদিন ধরে অনুরণিত একটা নাম। প্রথম আলোয় তানভীর অপু নামের একজন বিশ্বভ্রমণকারীর চোখে পড়েছিল। তখন জানতাম না তারেক অণু তানভীর অপুর ছোটভাই। অনেক পড়ে জেনেছি। 


সচলে তারেক অণুর ব্লগ নিয়মিত পড়লেও এক সময় পড়ায় ভাটা পড়ে। পরে একদিন তাঁর বই "পৃথিবীর পথে পথে" নজরে আসে। বইটা পড়ার ইচ্ছা ছিল বহুদিনের। 


পৃথিবীর পথে পথে বইটাতে লেখকের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। কখনও হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘার সুউচ্চ চূড়াতে বসে অক্সিজেনের কষ্টে ভুগছেন আবার কখনও মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় শ্বেতভল্লুক দেখতে ওৎ পেতে আছেন। হিমালয়ের সুউচ্চ পর্বতশ্রেণীতে বসবাসরত মানুষের জীবনযাত্রার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা আছে। আবার দেখা যাচ্ছে লেখক ল্যাটিন আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালায় রেড ইন্ডিয়ান কোনো বৃদ্ধা দাদীকে ছবি তোলার জন্য জোরাজুরি করছেন। আন্দিজে গেলে ক্যারিবীয় দ্বীপে তো যাবেনই। তাই ক্যারিবীয় দ্বীপে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বেরিয়ার রিপে ডুব দিতে ভোলেননি। ছোটবেলার ভয়ভীতি কাটিয়ে সাগরের অন্তঃপুরের রহস্য দেখে এসেছেন স্বচক্ষে। যেতে ভোলেননি বলিভিয়ার টিটিকাকা হ্রদেও। 


কখনও গিয়েছেন নিশাচর প্যাঁচার খোঁজে কিংবা আফ্রিকার বুনো প্রান্তরে। কালাকমুল জঙ্গল, ইয়ুকটানের অরণ্য, চিতোয়ানের গহীন বনের আছে রোমহর্ষক বর্ণনা। পড়তে পড়তে মনের অজান্তেই গা ছম ছম করে ওঠে। 


পাহাড় সমুদ্র অরণ্যের যেমন বর্ণনা আছে, তেমনি আছে ঐতিহাসিক স্থান। পৃথিবীবিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে তিনি গিয়েছেন। ইনকা, মায়া, এজটেক, মাচুপিচু যেমন আছে একদিকে তেমনি ওয়াটার লুর যুদ্ধময়দান, ভ্যাটিকান সিটি, পিসার হেলানো টাওয়ার, স্টোনহেনজের মতো ওয়ান্ডারসমূহ। 


আছে জনপদের চিত্র। রিও ডি জেনেরিও শহরের সেই বিশাল যীশুমূর্তি, ডারউইনের তীর্থ, ম্যান্ডেলার কনস্টটিউন্সি হিল কারাগার যেখানে মহাত্মা গান্ধীও আটক ছিলেন কিছুদিন। 


আর আছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বইয়ের দোকান: শেক্সপিয়র এন্ড কোম্পানি, ফ্রাঙ্কফুর্টের বৃহত্তম বইমেলা। হ্যামিলিনের সেই ছোট্ট শহর যেখানে অনেক শিশু বাঁশিওয়ালার পেছনে ছুটতে ছুটতে নিখোঁজ হয়ে যায়। এই গল্পের সত্যমিথ্যার কিছু আলামত বইটিতে আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই কিশোরী আনা ফ্রাঙ্কের যে গৃহে বন্দি ছিলেন, আমস্টারডামের সেই শহর আর গৃহের বর্ণনা, হেমিংওয়ের কিউবার বর্ণনা আছে। এমনকি ওল্ডম্যান এন্ড দ্যা সি'র সেই বৃদ্ধ ধীবরের ছবি দেখেছেন লেখক। 


লেখকের ভ্রমণ বহু পথে বহু দিকে। এক দিকে যেমন তাঁর পড়ার নেশা, অন্যদিকে তাঁর ঘোরার নেশা। জানাশোনার সাথে গ্রহণ করার মানসিকতা, আগ্রহ ও কৌতূহলও রয়েছে অনেক। তাই তো তাঁর পর্যটনে বাদ পড়ে না ভ্যান গগ, মাইকেল এঞ্জেলো, লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চিদের মতো মহান প্রতিভাদের বাসভূমি দর্শনের। দেখেছেন মধ্যযুগের সপ্তামাশ্চর্য হাজিয়া সোফিয়া। 


বইটি পড়তে পড়তে কাজী নজরুল ইসলামের "থাকব না'ক বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগতটাকে" কবিতার কথা মনে পড়ে যায়। লেখক সম্ভবত নজরুল মন্ত্রে দীক্ষিত। বইটি আমার কাছে হাতেরমুঠোয় বিশ্বের মতো। মনে হলো পৃথিবীর মানচিত্রের ওপর দিয়ে দ্রূত বেগে হেঁটে এলাম।


"পৃথিবীর পথে পথে" পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে লেখক একজন বিশ্বনাগরিক। চলার বাউন্ডারি তো নেই-ই; সাথে আছে লেখকের উদার মানসিকতা। ভ্রমণ যে মানুষের মনকে আরও উদার করে, মানুষ, পৃথিবী, প্রকৃতি ও প্রজাতির প্রতি যে আরও দায়িত্বশীল করে তা বইটি না পড়লে বোঝা যাবে না। 


ভ্রমণ বিষয়ে, পৃথিবী বিষয়ে, মানুষ ও জনপদ বিষয়ে, প্রাণী ও প্রকৃতি বিষয়ে যদি কারও আগ্রহ থাকে তাহলে পড়ে ফেলুন পৃথিবীর পথে পথে বইটি। বইটি আমি এখানে যেভাবে বর্ণনা করেছি তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। 

Post a Comment

0 Comments