সোফি'স ওয়ার্ল্ড (part-1)
Sophie's World
Jostein Gaarder
১৪ বছর বয়সের নরওয়েজিয়ান স্কুল বালিকা প্রতিদিনের মত মেইলবক্স চেক করতে গিয়ে দুইটা চিঠি পেল। একটাতে লেখা: তুমি কে? এবং কোথা থেকে এসেছ। এবং অন্যটিতে ১৫ তম জম্মদিনের শুভেচ্ছা– হিলডেকে লেখা তার বাবার চিঠি। যদিও চিঠিটা কেয়ার অফ সোফির নামে এসেছে।
তুমি কে এবং কোথা থেকে এসেছ এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই রহস্যজনক ব্যক্তি কিশোরী সোফির কাছে চিঠি লেখে। সোফিকে পরিচয় করে দেয় দর্শন এবং দার্শনিকদের সাথে।
#প্রাকৃতিক_দার্শনিক:
মিলেটাসের দার্শনিক:
পৃথিবীর প্রথম দার্শনিক ছিলেন থালেস। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৫ অব্দে তিনি সূর্যগ্রহণের প্রাকৃতিক কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন। আগের কারণগুলো ছিল পৌরাণিক। থালেসের সমসাময়িক ছিলেন এন্যাক্সিমানিডার (Anaximander) এবং এন্যাক্সিমিনিস ( Anaximenes)। এই তিনি প্রাচীন দার্শনিককে একসাথে বলা হতো মিলেটাসের (Miletus) এর দার্শনিক। এঁরা গ্রিসে এসেছিলেন এশিয়া মাইনর থেকে। দার্শনিক থালেস জলকে সবকিছুর উৎস মনে করেছিলেন। এবং সবকিছু আবার জলেই মিশে যাবে। এন্যাক্সিমানিডার মনে করতেন আমাদের বিশ্ব এমন বহু বিশ্ব থেকে এসেছে এবং সেই বিশ্বের সাথে আবার বিলীন হবে যে বিশ্বটা অসীম বা বাউন্ডলেস। এন্যাক্সিমানিসের চিন্তা-ভাবনা ছিল থালেসের মত। অর্থাৎ জল থেকেই সবকিছুর উৎপত্তি এবং জলকে বাষ্পে পরিণত করলে বায়ু হয় এবং চাপে কঠিন হয় এবং এই জলে তৈরি কঠিন দিয়েই পৃথিবী গঠিত।
এই তিন দার্শনিকই বিশ্বাস করতেন এ সবকিছুর পেছনে একটি মাত্র পদার্থ বা Substance রয়েছে কিন্তু কোন সে পদার্থ তা তাঁরা জানতেন না।
ইলিয়াটিক্স (Eleatics):
ইলিয়াটিক্স দার্শনিকদের মধ্যে পারমেনিডেস (Parmenides) মনে করতেন সবকিছুই আগে থেকে ছিল এবং কোনোকিছুই পরিবর্তন হচ্ছে না।
পারমেনিডিসের সমসাময়িক ছিলেন হেরাক্লিটস। তিনি প্রথম logos বা reason শব্দটা ব্যবহার করেন। এবং তিনি বলতে চেয়েছেন ইউনিভার্সাল রিজন আমাদের সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রায় সমসাময়িক Empedocles মনে করতেন চারটা উপাদান সবকিছুর মূল। এই চারটি উপাদান হলো: মাটি, বায়ু, আগুন এবং জল।
এটমের ধারণা:
Anaxagoras বিশ্বাস করতেন সবকিছুর কিছু কিছু সবকিছুর মধ্যে রয়েছে। Something of everything in everything. তিনি এই সবকিছুর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মূলকে seeds মনে করতেন।
Democritus মনে করতেন কিছু অদৃশ্য অপরিবর্তনীয় পদার্থ আছে যা সবকিছুর মূল। এই সব কিছুর মূলকে তিনি সর্বপ্রথম atom বলেছেন।
Democritus এর সাথে সাথে প্রাকৃতিক দর্শনের যুগ শেষ।
মেডিসিন এবং ইতিহাস: হিপোক্রিটাস মেডিকেল এথিকসের প্রচলন করেন। তিনি তাঁর ছাত্রদের মধ্যে মেডিকেল ওথ বা শপথ প্রচলন করেছিলেন। চিকিৎসা শপথ অনুযায়ী কোনো চিকিৎসক তার জানামতে কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে কোনো ওষুধ গ্রহণ করতে দেবেন না। রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখবেন। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সে সময়ও যখন গ্রিসে নাগরিক এবং দাস বলে দুই ধরণের লোক ছিল তখনও চিকিৎসকরা নাগরিক এবং দাসেদের মধ্যে বৈষম্য করতে না করেছেন।
ওরাকল অফ ডেলফি: দেবতা এপোলো পিথিয়া নামের পূজারীর মাধ্যমে ভবিষ্যৎবাণী করতেন। এবং "ওরাকল অফ ডেলফি" মন্দিরে গেইটে লেখা থাকত: "Know thyself"
সক্রেটিস: প্রাচীন গ্রিসে বিভিন্ন জায়গা থেকে জ্ঞানী এবং জানা-শোনা লোকের আগমন ঘটত। এঁদের বেশিরভাগই এথেন্সের নাগরিকদের লেখাপড়া শেখানোর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এই ভ্রমণকারী শিক্ষকদের সফিস্ট বলা হতো। সফিস্ট শব্দের অর্থ জ্ঞান এবং জানা-শোনা লোক- wise and informed person. সফিস্টদের সমসাময়িক কিন্তু সফিস্টদের সাথে যাঁর মিল ছিল না তিনি সক্রেটিস। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক। তিনি তাঁর নাটকীয় মৃত্যুর কারণে পৃথিবীর মানুষের কাছে বিখ্যাত হননি। তিনি এমন কিছু দ্ব্যর্থবোধক এবং রহস্যজনকভাবে কথা বলেছেন যে পরবর্তীতে যে যার মত ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন। সক্রেটিস একটি বইও লিখে রেখে যাননি যদিও তাঁর আগে থেকে অনেক দার্শনিকই বই লিখতেন। সক্রেটিসের বেশিরভাগ কিছু আমরা জানতে পারি তাঁর ছাত্র প্লেটোর মাধ্যমে।
দেখতে বিশ্রী সক্রেটিস নিজেকে একজন ধাত্রী বলে পরিচয় করে দিতেন। অর্থাৎ তিনি জ্ঞানের স্রষ্টা না; মানুষের মধ্যে থেকে তিনি জ্ঞান বের করে আনতেন। অবশ্য, সক্রেটিসের মা বাস্তবে একজন ধাত্রী ছিলেন।
সক্রেটিস কাওকে প্রশ্ন করে এমন ভাব করতেন তিনি কিছু জানেন না। তিনি এটা বলতেনও I only know I know nothing. সক্রেটিস মনে করতেন দর্শনের ক্ষেত্রে উত্তর প্রদানের চেয়ে প্রশ্ন করতে পারা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য তিনি বলেছেন, One question can be more explosive than a thousand answers.
সক্রেটিসের সাথে আরেকজন ব্যক্তির তুলনা করা হয় তিনি হলেন যীশু খ্রিস্ট। এই দুইজনের প্রায় একই পরিণতি হয়েছে। এবং এই দুইজন কেউই কিছু লিখে রেখে যাননি। সে জন্য দুইজনকে তাঁর পরবর্তীরা নিজের মত করে ব্যাখ্যা করতে পারে।
সক্রেটিসের আরেকটি বড় অবদান, রোমান দার্শনিক সিসেরো বলেছেন সক্রেটিস দর্শনকে আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়েছিলেন।
সক্রেটিসের প্রভাব পশ্চিমা দার্শনিকদের মধ্যে এখনও বিদ্যমান।
প্লেটো: সক্রেটিসের সরাসরি ছাত্র প্লেটো সক্রেটিসের শিক্ষা নিয়ে ডায়লগ অফ সক্রেটিস বইটি লেখেন। প্লেটোর অবদান এতটুকুতেও না। তিনি Academus নামে School of Philosophy শুরু করেছিলেন।
প্লেটোর দর্শন হলো যা শ্বাশত বা অপরিবর্তনীয় তার সাথে যা পরিবর্তনশীল তার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা। তিনি মনে করতেন প্রকৃতিতে আমরা যা দেখি তা পরিবর্তনশীল কিন্তু এর আইডিয়া বা Form আগে থেকে ছিল। আমরা যেটা দেখতে পারি সেটা ইন্দ্রিয় এবং যেটা দেখতে পারি না সেটা শ্বাশত। এই শ্বাশতকে তিনি বলছেন Idea বা Form বা Reason।
যদি একটা ঘোড়ার উদাহরণ দেয়া যায় তাহলে বিষয়টা ক্লিয়ার হবে। আমরা যে ঘোড়া দেখি সেটা পরিবর্তনশীল কিন্তু এই ঘোড়ার আইডিয়া বা ফর্ম আগে থেকেই ছিল। যেমন আমি যদি কোনো হাতির ছবি আঁকি তাহলে অবশ্যই হাতির ফর্ম বা আইডিয়া আমার মধ্যে থাকতে হবে।
প্লেটোর রাজনৈতিক চিন্তা: রাজনীতির বিষয়ে প্লেটোর কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তিনি মনে করতেন মস্তিষ্ক যেমন দেহকে গভর্ন করে তেমনি দার্শনিকদের উচিত রাষ্ট্র পরিচালনা করা। প্লেটো মনে করতেন যে রাষ্ট্র নারীকে শিক্ষিত না করে সে রাষ্ট্র এমন মানুষের মত যারা শুধু ডান হাত ব্যবহার করে। তিনি মনে করতেন শাসক এবং সৈন্যদের ব্যক্তিগত সম্পদ থাকতে পারবে না। তিনি বাচ্চাদের শিক্ষিত করার জন্য রাষ্ট্র পরিচালিত সার্বক্ষণিক নার্সারি স্কুলের কথা বলেছেন।
এরিস্টটল: এরিস্টটলের জন্ম মেসিডোনিয়াতে। তিনি প্লেটোর ছাত্র ছিলেন। তিনি যখন এথেন্সে আসেন তখন প্লেটোর বয়স ৬১ বছর। এরিস্টটল প্রকৃতিবাদী ছিলেন। তিনি প্লেটোর শ্বাশত এবং পরিবর্তনশীল বিষয় সমর্থন করতেন না। তাঁর ধারণা ছিল যে হাতির ছবি আঁকবে অবশ্যই সে হাতি দেখে থাকবে। সুতরাং শ্বাশত ফর্ম বা আইডিয়া বলে কিছু নেই।
এরিস্টটল মনে করতেন প্রত্যেক কিছুর পেছনে একটি কারণ আছে। তিনি এই Cause বা কারণকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন ধরা যাক বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি হওয়ার পেছনে চারটি কারণ রয়েছে:১) বৃষ্টি হওয়ার জন্য আদ্রতা রয়েছে। এটাকে Material Cause বলে। ২) এবং সে আদ্রতা শীতল হয় এটাকে Efficient Cause বলে। ৩) পানির প্রকৃতির কারণে পানি জমাটবদ্ধ হয় এবং সে কারণে মাটিতে পড়ে। এটা হলো Formal Cause। এই তিনটা কারণই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এরিস্টটল আরেকটি কারণ যোগ করেন সেটি হলো গাছ-পালা, প্রাণী এবং প্রকৃতির জন্য বৃষ্টির দরকার আছে। সে কারণে বৃষ্টি হয়। এটাকে তিনি Final Cause বলেছেন।
জ্ঞানের অনেক শাখার জনক এরিস্টটল নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন না।
সোফি'স ওয়ার্ল্ড বইয়ের প্রথম একশো পেজের রিভিউ দিলাম। অনেকের জানার অনেক আগ্রহের কারণে রিভিউটা ইচ্ছা করে বড় করেছি। এখনো তিনটা কিস্তিতে আরও তিনটি রিভিউ দেয়ার ইচ্ছা আছে।
পশ্চিমা দর্শনকে সহজে জানতে বইটি পড়তে পারেন। বইটি শুধু দর্শন হিসেবে নয় ফিকশন হিসেবেও অসাধারণ। পড়তে পড়তে আপনার মাঝে মাঝে মনে হতে পারে এ জীবন নশ্বর। এর কোনো মিনিং নেই। এবসার্ড। আবার মনে হতে পারে জীবনের মানেই হলো চিন্তা করতে পারা- দর্শনচিন্তা করা। যেত এরিস্টটল তিন লেভেলের সুখের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রেখেছেন দর্শন-চিন্তাকে।
0 Comments