ঝিনুক নীরবে সহো
মধুর ক্যান্টিনে নাশতা খেয়ে বিল না দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে দুই তরুণ। তাদের পেছন পেছন ধাওয়া করছে মধুর ক্যান্টিনের ক্যান্টিন বয়। আহমদ শরীফ আর আনিসুজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কলাভবনের সামনে ক্যান্টিন বয়দের বিল পরিশোধ করে শিক্ষকের দায় মেটালেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝরে-পড়া এই দুই তরুণকে চেনে না এমন লোক খুব কমই আছে। এঁদের দুইজনের উদ্দেশ্যই কবি হওয়া। একজন এসেছেন বারহাট্টা, নেত্রকোনা থেকে। আরেকজন বরিশাল থেকে।
"ঝিনুক নীরবে সহো" মোশতাক আহমদ কর্তৃক রচিত ডকুফিকশান। উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে আবুল হোসেন মিয়া নামের এক ক্ষণজন্মা প্রতিভাবান কবির জীবনকাহিনী। আবুল হাসান হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো এসেছিলেন। বাংলা সাহিত্যকে দিয়ে গেছেন হৃদয় উজাড় করে। আবুল হাসানের জীবনী লিখতে গিয়ে লেখক ধারণ করেছেন ষাট আর সত্তর দশকের অর্ধেক সময়কে।
মধুর ক্যান্টিন তখন এখনকার মতোই রাজনৈতিক মিটিং মিছিলের জন্য বিখ্যাত ছিল। আর তথাকথিত আতেল কবি-শিল্পীদের জন্য ছিল লাইব্রেরির পাশে শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন। শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে বারহাট্টা থেকে আগত নির্মলেন্দু গুণ আর বরিশাল থেকে আগত আবুল হোসেন মিয়া বাকিতে খেতেন। পরে কোনো সিনিয়র বা বন্ধু খাবারের বিল পরিশোধ করে দিতেন।
কবি স্বীকৃতি জুটেছে দুই কবিরই। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ কর্তৃক প্রকাশিত "কন্ঠস্বর" পত্রিকায় দুইজনেরই কবিতা ছাপা হচ্ছে। আহসান হাবিবের পত্রিকায় কবিতা ছাপানোর জন্য আহসান হাবিবের কবিতা মুখস্থ বলে ইমপ্রেস করার কৌশল নির্মলেন্দু গুণের। আর আবুল হোসেন মিয়ার কবিতায় ছাপা হয়েছে "সংবাদে"। শামসুর রাহমান পড়েছেন সে কবিতা।
আবুল হোসেন মিয়া নামটা নিয়ে তখনও তিনি দ্বিধান্বিত। রফিক আজাদ, হুমায়ুন কবির, শহীদ কাদরী সবাই বলছেন আবুল হোসেন গ্রাম্য নাম। কবিতার জন্য একটু চেঞ্জ দরকার। পরবর্তীতে হোসেনকে হাসান করে দিলেন।
হুমায়ুন আজাদও ক্লাসের মেধাবী ছাত্র। কবিতা লেখেন কিন্তু এড়িয়ে চলেন কবিদের সঙ্গ। স্বাধীনতার পরে "অলৌকিক ইস্টিমার" কাব্যগ্রন্থ বের করলেন। এই বইয়ের শেষের কবিতাটি "হুমায়ুন আজাদ" শিরোনামে। এটা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আবুল হাসানও লিখে ফেললেন "আবুল হাসান" শিরোনামের কবিতা। "রাজা যায় রাজা আসে" কাব্যের প্রথম কবিতা "আবুল হাসান"।
হাসানের ইতোমধ্যে বিচ্ছেদ ঘটেছে বাল্যপ্রেমিকা সুলতানা রাজিয়া খোন্দকারের সাথে। সংক্ষেপে তাঁকে তিনি সু রা খো র বলে ডাকেন। জিসি দেবের পালকপুত্র বিশিষ্ট গল্পকার জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের স্ত্রী পূরবী বসু কিছুটা চেষ্টা করেও রাজিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করাতে পারেননি। বেদনা বিধুর হৃদয়ে সান্ত্বনার বাণী নিয়ে আসেন নির্মলেন্দু গুণ। পুরান ঢাকার এক পানশালায় আকন্ঠ সুরা পান করে দুইজনে লিখে ফেলেন "বোহেমিয়ান কবির সংবিধান"।
কবি-সন্ন্যাসী এই কবিদ্বয় এর মধ্যে ছন্নছাড়ার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন কখনও ফুটপাতে ঘুমিয়ে, কখনো বা ইপিআরসির বাসের জানালা ভেঙে ভিতরে ঘুমিয়ে, কখনো বা পাবলিক লাইব্রেরির বারান্দায়। সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে ঘুমিয়েছেন কয়েক বার। তাদের জন্য ঢাকা শহরে রান্না হয় সব বাড়িতে। পকেটে টাকা নেই। যখন ইচ্ছা যার বাড়ি থেকে খেয়ে আসতে পারেন। আর তা না হলে শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন তো আছেই।
লেখক সংঘের পত্রিকা ছিল "পরিক্রমা" এখানে দুই বোহেমিয়ান কবিকে কাজ দেন হাসান হাফিজুর রহমান। তাদের ছন্নছাড়া জীবনের একটি গতির জন্যই। কিন্তু অফিসের কর্মচারীদের মেরে আর জানালা ভেঙে পরিক্রমার অফিসে ঢুকে ঘুমানোর জন্য এ পথটাও বন্ধ হয়ে যায়।
এভাবে একদিন আসে একাত্তরের পঁচিশ মার্চ সেই ভয়াল কালরাত। হাসান অসুস্থ। হৃৎপিণ্ড বড়ো হয়ে গেছে। ডা. ফজলে রাব্বী তাঁকে চিকিৎসা করেন। ১৪ ডিসেম্বর এই মহান ডাক্তারকে হত্যা করা হয়। ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র সুকান্ত কবি আবুল হাসানের সেবা করেন। হাসানের প্রিয় বন্ধু নির্মল আর মহাদেব তখন ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। আশ্রয় নিয়েছেন আহমদ ছফা। শামসুর রাহমান আল মাহমুদ আগেই পাকিস্তান সরকারের টার্গেট ছিলেন। দেশে আছেন শহীদ কাদরী বিশেষ পাস নিয়ে।
সদ্য স্বাধীন দেশে ফিরে এসেছেন অনেকেই। তখন নতুন একটি সাহিত্য ভাষার জন্য তরুণ কবি সাহিত্যিকদের নজরকাড়া উদ্যোম। আহমদ ছফা এর নেতৃত্বে। পরোপকারী নিঃস্বার্থ এই লোকটি স্বাধীনতার আগেই হাসানকে সাড়ে তিন'শ টাকা দিয়েছিলেন যাতে ছাত্রত্ব ফিরে পায়। আবুল হাসান ছাত্রত্ব ফিরে পাননি।
সুরাইয়া খানম, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে বহির্বিশ্বে জনমত গঠনে রয়েছে তাঁর অসামান্য অবদান। বেশভুষা, কথা-বার্তা আর আচরণে স্বাধীনচেতা এই বিদুষী নারী উপমহাদেশের প্রথম ক্যামব্রিজ স্কলার। ইনি ঔপন্যাসিক দিলারা হাশেমের মেজো বোন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সুরাইয়া খানমকে বলেছিলেন, তুই দেখতে আমার মায়ের মতো। আজ থেকে তুই আমার মা।
সুরাইয়া ক্যামব্রিজের ট্রিপল অনার্সধারী হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি প্রভাষক পদে যোগদান তাঁর জন্য সহজ ছিল না। তাঁর স্বাধীন স্বভাব অনেকে মেনে নিতে পারেননি। সুরাইয়ার জন্য আহমদ ছফা সিরাজুল ইসলাম খানের সাথে ঝগড়া করেন। তখন অনেকের ধারণা হয়েছিল ছফা-সুরাইয়ার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক থাকতে পারে।
কিন্তু সম্পর্ক হলো শেষ পর্যন্ত আবুল হাসানের সাথে। আবুল হাসানের আয়ু তখন বেশিদিন নেই। সরকারের বিশ হাজার আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাঁচ হাজার টাকার চিকিৎসা সহায়তা নিয়ে পূর্ব জার্মানি থেকে চিকিৎসা নিয়ে এসেছেন। তিনি বেশিদিন বাঁচবেন না সেটা জানেন সবাই। তবুও এই মৃত্যুপথযাত্রী কবিকে ভালোবেসে আপন করে নিলেন তখনকার সময়ের মক্ষীরানী সুরাইয়া খানম যাঁর সাথে প্রেম করার জন্য অসংখ্য যুবক লাইন ধরে আছে। এমনকি আহমদ ছফা-ও যেন আবুল হাসানের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন।
পূর্ব জার্মানিতে চিকিৎসারত থাকাকালে হাসানের রাইনহার্ট নামে একজন চিত্রশিল্পীর সাথে বন্ধুত্ব হয়। তিনি সারাজীবন হাসানের স্মৃতি বুকে জড়িয়ে চলতি বছরের মার্চ মাসে মৃত্যুবরণ করেন।
পঁচাত্তরের আগস্ট বাঙালি জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। হাসান মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। নির্মলেন্দু গুণের সাথে বন্ধুত্ব আগের মতো নেই। হাসান আর গুণের মধ্যে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে সুরাইয়া। সুরাইয়াকে গুণ সিআইএর এজেন্ট বলে সন্দেহ করেন। নিজে ভীত হয়ে ঢাকা ছেড়েছেন। পরে হাসানের চিঠি পেয়ে ঢাকা আসেন। হাসান তখন মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে পিজি হাসপাতালে ভর্তি। বন্ধুকে দেখতে এসে সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন।
১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর অসংখ্য ভক্ত আর শুভাকাঙ্ক্ষী রেখে ভোর ছয়টা বিশ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন। পৃথিবী হারায় এক প্রতিভাবান কবিকে।
"ঝিনুক নীরবে সহো" মোশতাক আহমদ কর্তৃক রচিত ডকুফিকশান। উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে আবুল হোসেন মিয়া নামের এক ক্ষণজন্মা প্রতিভাবান কবির জীবনকাহিনী। আবুল হাসান হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো এসেছিলেন। বাংলা সাহিত্যকে দিয়ে গেছেন হৃদয় উজাড় করে। আবুল হাসানের জীবনী লিখতে গিয়ে লেখক ধারণ করেছেন ষাট আর সত্তর দশকের অর্ধেক সময়কে। বইটি পড়া মানে বিংশ শতাব্দীর বাঙালির শ্রেষ্ঠ দশক ষাটের দশক আর মুক্তির দশক সত্তর দশকের সময়ে টাইম ট্রাভেল করে আসা। বইটি যেন জ্বলজ্যান্ত টাইম মেশিন। বইটি সম্পর্কে আমার মন্তব্য: বইটি না পড়লে পাপ হতো।
0 Comments