সোফি'স ওয়ার্ল্ড (দ্বিতীয় অংশ)

 সোফি'স ওয়ার্ল্ড রিভিউ


সোফি'স ওয়ার্ল্ড (দ্বিতীয় অংশ)

হেলেনিস্টিক সংস্কৃতি


এরিস্টটলের মৃত্যুর পরে গ্রিক সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এটা যে এরিস্টটলের মৃত্যুর কারণে হয়েছে সে রকম নয়। আলেকজান্ডার, মেসিডোনিয়ায় জন্ম এবং এরিস্টটলের ছাত্র, গ্রিস, উত্তর আফ্রিকা এবং পারস্য বিজয় করে এবং গড়ে ওঠে হেলেনিস্টিক নামে এক সংস্কৃতি।

হেলেনিস্টিক সংস্কৃতি অনেকটা আজকের বিশ্বের মত  যেখানে এক সংস্কৃতির সাথে আরেক সংস্কৃতির মিশে যাওয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক। হেলেনিস্টিক সংস্কৃতিতে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ নগরী হয়ে ওঠে। আর গ্রিস আগের মতই থেকে যায় দার্শনিকদের মিলস্থল হিসেবে। 


হেলেনিস্টিক যুগে কয়েকটি দার্শনিক ধারা প্রভাবশালী হয়েছিল। যেমন:

 সংশয়বাদ (Cynicism)

নির্বিকারবাদ (Stoicism)

ভোগবাদ (Epicureanism)

মর্মীবাদ (Mysticism)

নয়াপ্লেটোবাদ (Neoplatonism)


সেমেটিক প্রভাব এবং দর্শনের মধ্যযুগ:


হেলেনিস্টিক সংস্কৃতির অবসান এবং যীশু খ্রিস্টের জম্ম ও খ্রিস্টান ধর্মের প্রসার দর্শন-চিন্তাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। 


খ্রিস্টের জম্মের প্রথম চার শতকের মধ্যে রোম সাম্রাজ্য আস্তে আস্তে দুর্বল হতে থাকে। রোম সাম্রাজ্য ভেঙে দুই ভাগ হয়ে যায় পঞ্চম শতাব্দীতেই। পশ্চিম দিকের অংশের রাজধানী হয় রোম এবং পূর্ব দিকের রাজধানী হয় কনস্টান্টিনোপল। অটোমান সাম্রাজ্যের দখলের আগে পর্যন্ত কনস্টান্টিনোপল টিকে ছিল। 


যীশু খ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছরের মধ্যে অন্য একটি সেমেটিক ধর্ম ইসলামের প্রসার শুরু হয়। বলে রাখা ভালো জিউ, খ্রিস্টান এবং ইসলাম তিনটাই সেমেটিক ধর্ম। পশ্চিমা দর্শনের পরবর্তী চিন্তা-ধারায় এই তিন ধর্মের প্রভাব অপরিসীম। তবে, খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্মের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। 


সেমেটিক ধর্মের আগে গ্রিক, পারস্য এবং ভারত এই তিন ইন্দো-ইউরোপীয় সংস্কৃতি এবং দর্শনচিন্তার মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য পাওয়া যায়। আর্যরা সম্ভবত কাস্পিয়ান সাগর এবং কৃষ্ণসাগরের উপকূল থেকে ভারতবর্ষ এবং পশ্চিমের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই এদের দেব-দেবী, পৌরাণিক কাহিনী এবং দর্শনচিন্তাতে রয়েছে দারুণ মিল। 


সেমেটিক, আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে খ্রিস্টান এবং ইসলাম, ধর্মের প্রসারে পশ্চিমা দর্শন তিনভাগে ভাগ হয়ে যায়। পশ্চিম দিকে রোমকে কেন্দ্র করে নয়াপ্লেটোবাদ, পূর্বদিকে বাইজেন্টাইনকে কেন্দ্র করে প্লেটোবাদ এবং আলেকজান্দ্রিয়াকে কেন্দ্র এরিস্টটলবাদ প্রভাববিস্তার করে। এর মধ্যে আলেকজান্দ্রিয়াকে কেন্দ্র করে মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং দর্শন বিকাশ লাভ করে। আলেকজান্দ্রিয়া আগে থেকেই গণিত, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যার কেন্দ্র ছিল। মুসলিমরা একে আরও বিকশিত করে। 


একাদশ শতাব্দীতে খ্রিস্টান স্কলারদের আমন্ত্রণে মুসলিম স্কলাররা উত্তর ইতালিতে আগমন করে। এর আগে মুসলিমরা স্পেন জয় করে ফেলেছে। মুসলিমদের সাথে মেশার সুযোগের কারণে পশ্চিমারা এরিস্টটলের দর্শন সম্পর্কে জানতে পারে। একিউনাস নামের এক দার্শনিক এরিস্টটলের দর্শনকে খ্রিস্টানাইজ করেন। এরিস্টলেকে যখন খ্রিস্টীয় দর্শনের চশমায় দেখা হলো তখন এরিস্টটলের এন্টি-ফেমিনিজমটাও খ্রিস্টান ধর্মের সাথে মিশে গেল। এর আগে সেন্ট অগাস্টিন প্লেটোকে খ্রিস্টানাইজ করেছিলেন। 


রেনেসাঁ যুগ: 


রেনেসাঁ অর্থ জ্ঞানের পুনর্জন্ম। পঞ্চম শতাব্দীতে ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম এবং দর্শন-চিন্তায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। মার্টিন লুথার বাইবেলকে গ্রিক এবং হিব্রু ভাষা থেকে নিজ নিজ ভাষায় অনুবাদ করেন। পাদ্রীদের সাথে সে কারণে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে হয়। কেননা, চার্চ সে সময় মনে করত বাইবেল পড়ার অধিকার শুধু চার্চের আছে। এবং গডের কাছে প্রার্থনা করতে হলে চার্চের মাধ্যমে করতে হবে। রিফরমিস্টরা বললেন, না। চার্চের মাধ্যম ছাড়াই গডের কাছে মেসেজ পাঠানো সম্ভব। 


এই যুগেই গ্যালিলিও, ব্রুনো, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, নিউটন, কোপার্নিকাস প্রমুখের জন্ম হয়। ব্রুনোকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। 


শুধু ধর্ম কিংবা বিজ্ঞান নয়; রেনেসাঁ যুগেই মানুষ ভাবতে শেখে হিউম্যান ইজ নট ফর অনলি গড'স সেইক। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বিকাশ লাভ করে। মানুষ মানুষকে নিয়ে, মানবতাকে নিয়ে ভাবতে শেখে। 


রেনেসাঁ যুগের দার্শনিকদের দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে আছেন ডেসকার্ট, স্পিনোজা এবং লিবনিজ। এঁরা Rationalist ছিলেন। ডেসকার্টকে বলা হয় আধুনিক দর্শনের জনক। তিনি এনালিটিক্যাল জিওমেট্রির জনক। স্পিনোজা একজন ইহুদি ছিলেন এবং প্রথম তিনি ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্মে উল্লেখিত পৌরাণিক কাহিনীকে মিথ্যা বলেছিলেন। দ্বিতীয় ভাগে আছেন জন লক, বার্কলি এবং হিউম। এঁরা ছিলেন এমপিরিসিস্ট। এমপিরিসিস্ট বা Empiricist শব্দটা empirical শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ হলো: observation, experience and experiment দ্বারা লব্ধ জ্ঞান।


এনলাইটেনমেন্ট: 


অষ্টাদশ শতাব্দী ছিল ইউরোপে এনলাইটেনমেন্টের যুগ। এ যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক ছিলেন ইমন্যুয়েল কান্ট। আরও কয়েকজন বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন মন্টেসকু, ভোল্টেয়ার এবং রুশো। এনলাইটেনমেন্ট যুগে গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস এবং প্লেটোর ইউনিভার্সাল রিজন এবং ইউনিভার্সাল রাইট পুনরায় জনপ্রিয়তা পায়। 


 এনলাইটেন্টমেন্ট যুগের সবচেয়ে বড় ঘটনা ১৭৮৯ সালে ফ্রেঞ্চ রিভলিউশন। ফ্রেঞ্চ রিভোলিউশনের মাধ্যমে "সব মানুষ সমান" প্রতিষ্ঠা করা হয়, যদিও এখানে মানুষ বলতে পুরুষকে বোঝানো হয়েছে; নারীকে নয়। ফ্রেঞ্চ রিভোলিউশনের পর থেকেই নারীবাদ সামনে আসতে শুরু করে। ফ্রেঞ্চ রিভোলিউশনে নারীদের অনেক অবদান ছিল। কিন্তু ফ্রেঞ্চ রিভোলিউশনে নারীদের অধিকারের বিষয়ে কোনোকিছু বলা হয়নি। ফ্রেঞ্চ রিভোলিউশনের এক্টিভ নারী কর্মী অলিম্পিয়া গগস ১৭৯৩ সালে একটি ঘোষণা পাবলিশ করেন যেখানে তিনি দাবি করেছেন পুরুষের যে অধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে নারীদেরও তাই দিতে হবে। এবং এ কারণে সম্ভবত তাঁকে শিরোচ্ছেদ করা হয়। যদিও অন্য দলিলে তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলে পরিচয় করা দেয়া হয়েছে। 


এনলাইন্টেনমেন্ট যুগের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো ২৮ খণ্ডের এনসাইক্লোপিডিয়া যেখানে পৃথিবীর অনেক স্কলাররা অবদান রাখেন। এতে বলা হয় এভরিথিং ক্যান বি ফাউন্ড হেয়ার ফ্রম নিডলস টু ক্যানন। 


রোমান্টিসিজম: 


অনুভূতি, স্বপ্ন, সৌন্দর্য, আলস্য, মিডল ক্লাসের প্রতি বিতৃষ্ণা প্রভৃতি রোমান্টিক এজের বৈশিষ্ট্য। এই যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক ছিলেন Schelling, Novalis এবং Steffen। রোমান্টিক যুগ শুরু হয় জার্মানিতে। এই যুগকে বলা হয় ইউরোপের প্রথম ছাত্র-অভ্যুত্থান। এই যুগের রোমান্টিকরা বেশিরভাগই ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল কিন্তু লেখা-পড়াকে গুরুত্বের সাথে নেননি। রোমান্টিক যুগে প্রায়ই বলা হতো: Idleness is the ideal of genious and indolence the virtue of the Romantic. 


রোমান্টিক এজ-ই ছিল ইউরোপের লাস্ট কমন এপ্রোচ। এর পর থেকে দার্শনিকরা স্বতন্ত্রভাবে পরিচিত হন।


সোফি'স ওয়ার্ল্ডের আজ ছিল দ্বিতীয় কিস্তি। বিশাল ব্যাপক দর্শন এবং দার্শনিকদের এত ছোট পরিসরে আনা খুবই কষ্টকর। তবুও পশ্চিমা দার্শনিকদের সাথে মোটামুটি পরিচিত হওয়ার জন্যই এই সামান্য প্রচেষ্টা। 


দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটা আপনাকে নতুন করে ভাবতে শেখাবে। ভিতর থেকে লন্ডভন্ড করে দিতে পারে। আরেকটি কথা যাঁরা দর্শন নিয়ে সাধনা করেছেন তাঁদের বেশিরভাগই জীবনে প্রাচুর্য চাননি। বেশিরভাগই মনে করতেন জ্ঞান অর্জনের জন্য দরিদ্র হতে হবে। সিম্পল হতে হবে। Simplicity is their vanity. 


দর্শন মানে কোনোকিছুর উত্তর পাওয়া না। দর্শন মানে জিজ্ঞাসা। যে যত বেশি জিজ্ঞাসা করতে পারবে সে তত বড় দার্শনিক। 


দর্শনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কনক্লুশন হলো: দর্শনে কোনো কনক্লুশন নেই।

Post a Comment

0 Comments