১৬০০ সালের শেষ দিন ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন ২১৫ জনের স্বাক্ষর সংবলিত চার্টার অফ ইস্ট ই
ন্ডিয়া কোম্পানি ব্রিটেনের রানী কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয়। ৭০০০০ পাউন্ড শেয়ার মূলধন নিয়ে গঠিত পৃথিবীর প্রথম কোম্পানিটি পরবর্তীতে পৃথিবীর ইতিহাসকে বদলে দেয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠিত হওয়ার পেছনে রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। ১৪৯৮ সালে ভাস্কো ডা গামার ভারতের জলপথ আবিষ্কারের পরে ক্যাথলিক পর্তুগিজ অর্থ বাণিজ্য ও শক্তিতে বেশ এগিয়ে যায়। অন্যদিকে, ক্যাথলিক স্পেন কর্তৃক আমেরিকা আবিস্কার স্পেনের শক্তিমত্তাকে আরো বাড়িয়ে তোলে।
"ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস" তীর্থংকর রায়ের লেখা তথ্যসমৃদ্ধ একটি চমৎকার বই। ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস, তৎকালীন ব্যবসায়-বাণিজ্য প্রকৃতি, কোম্পানি শাসন প্রভৃতি বিষয়ে নিরপেক্ষ ইতিহাস জানতে বইটির বিকল্প নেই।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দশকে ইংলিশম্যানরা ভারতে আসার প্রস্তুতি শুরু করে। ভারত মহাসাগরে বাণিজ্য করতে আসার সম্ভাব্য কয়েকটি ঝুঁকির মধ্যে একটি বড়ো ঝুঁকি ছিল ভারত মহাসাগরে পর্তুগিজ অধিপত্য। জলদস্যু ড্রেক কর্তৃক ব্রাজিলের উপকূল থেকে লুন্ঠনকৃত কয়েকটি স্পেনীয় জাহাজ আর মানচিত্র ব্রিটিশদের কিছুটা সাহায্য করলেও প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় মূলধন।
মূলধনের প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্যই গড়ে তোলা হয় অভূতপূর্ব যৌথমূলধনী ব্যবসায় মডেল। এর আগে পার্টনারশিপ জাতীয় ব্যবসায় মডেলের ঐতিহাসিক কিছু অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও মালিকপক্ষ থেকে ব্যবস্থাপনা আলাদা করে গড়ে ওঠা প্রথম প্রতিষ্ঠানটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কোম্পানির অফিসিয়াল নাম ছিল "দি কোম্পানি অফ মার্চেন্টস অফ লন্ডন ট্রেডিং টু ইস্ট ইন্ডিজ" ডাকনাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
এখানে বলে রাখা ভালো ব্যবসায় আর লুটপাটের মধ্যে তখন পার্থক্য ছিল খুব কমই। সেটা জানা যায় কোম্পানির প্রথম অভিযানে। ১৬০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক সকালে উলিচ ডক থেকে ভারত মহাসাগর অভিমুখে ছেড়ে যাওয়া পাঁচটি জাহাজের সবচেয়ে বড়ো জাহাজটির বাম রেড ড্রাগন। ওজন ছিল ৬০০ টন। তখনকার সময়ে সবচেয়ে বড়ো জাহাজ। পাড়ি দিতে হবে দশ হাজার মাইল দীর্ঘ সমুদ্রপথ। অভিযানের প্রধান ল্যাংকাস্টার গভর্নর জেনারেল উপাধি নিয়ে নেতৃত্বে আছেন। সফরসঙ্গী আছেন আরও তিন'শ জন। বিশ মাস সমুদ্রে থাকার প্রয়োজনীয় খাবার সাথে রাখা হয়েছে যার মূল্য ৬৬০০ পাউন্ড। ৪৫০০ পাউন্ড মূল্যের উপহারসামগ্রী। আর আছে ৩০০০০ পাউন্ড মূল্যের সোনা-রূপা পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে।
কোম্পানির প্রথম অভিযান প্রথমে যায় ইন্দোনেশিয়া। ইন্দোনেশিয়ায় মশলা বিশেষ করে গোলমরিচের কারবার। ইউরোপে গোলমরিচের তখন ব্যাপক চাহিদা। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ায় রাজা কর্তৃক সমাদৃত হলেও ব্যবসা করে সুবিধা করতে পারল না। বেশিরভাগ মসলা হয় ডাচ কিংবা পর্তুগিজরা আগেই অর্ডার করে রেখেছে। কোম্পানি তখন বেছে নেয় ভিন্ন পথ। পর্তুগিজ একটি গোলমরিচের জাহাজ লুন্ঠন করে। এই গোলমরিচ ইংল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে কোম্পানির প্রথম লাভ হয় দশ লক্ষ পাউন্ড।
ভারত মহাসাগরে বাণিজ্য মানেই অতি উচ্চ মুনাফা। কখনও কখনও মুনাফা এক হাজার শতাংশের বেশি। আর তাছাড়া, আছে বিশেষ এক সুবিধা। রানী কর্তৃক প্রাপ্ত একচেটিয়া ব্যবসায়ের সুবিধা। অর্থাৎ ইংল্যান্ডের আর কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ভারত মহাসাগরে বাণিজ্য করতে পারবে না। পারলেও কোম্পানির অনুমতি সাপেক্ষে।
এত সুবিধার পরেও কোম্পানির প্রধান সমস্যা হয়ে রইল বিনিময়ের মাধ্যম। রানীর নিরদর্শনা ছিল বৈদেশিক বাণিজ্যে কোম্পানি যে পরিমাণ স্বর্ণ-রৌপ্য বাইরে নিয়ে যাবে, ঠিক সে পরিমাণ স্বর্ণ-রৌপ্য ইংল্যান্ডে ফেরত নিয়ে যেতে হবে। ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট (বিওপি) কোম্পানির প্রধান মাথাব্যথা হয়ে রইল।
সমাধান পেয়েও গেল। ইন্দোনেশিয়াতে ভারতের সুতি কাপড়ের ভালো বাজার আছে। কোম্পানি ভারতের কাপড় ইন্দোনেশিয়ায় বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে গোল মরিচ ক্রয় করে ইংল্যান্ডে রপ্তানি করতে লাগল। এতে বিওপি ঠিক থাকল। প্রচুর পরিমাণে মুদ্রা দেশের বাইরে গেল না।
আগেই বলেছি, কোম্পানির ব্যবসায় এবং লুটপাটের মধ্যে পার্থক্য ছিল খুব কমই। ব্যবসা করার স্বার্থে ভারতের বিভিন্ন রাজা, মন্ত্রী এবং আমলাদের ঘুষ দেওয়া হতো। ঘুষ ছাড়াও বিওপি ঠিক রাখার জন্য বেছে নিত আরও জঘন্য কিছু পথ। এর মধ্যে একটি ভয়ঙ্করতম হলো চীনে আফিমের প্রচলন।
অষ্টাদশ আর উনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ড এবং আমেরিকাতে চা খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রচুর পরিমাণে চা আমদানি করতে গিয়ে ব্যালেন্স অফ পেমেন্টে ঘাটতি পড়ে যায়। চীনের চা ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই চায়ের কারণে ইউএস স্বাধীন হয়। বোস্টন টি পার্টির কথা আমরা জানি। ব্রিটেনের রাজা যুদ্ধব্যয় মেটানোর জন্য আমেরিকাতে রপ্তানিকৃত চায়ের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক ধার্য করলে আমেরিকার ১৩ টি স্টেট স্বাধীনতা ঘোষণা করে। অন্যদিকে, ইংল্যান্ডে চা আমদানি করতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে রৌপ্য চলে যায় চীনে। বিওপি ঠিক রাখতেই কোম্পানি উপমহাদেশের বাংলা এবং বিহার থেকে আফিম নিয়ে চীনে বিক্রি করে। চীনের রাজা আফিম বিক্রি বন্ধ করতে কোম্পানিকে চীনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এক সময় চীনের প্রতি পাঁচজনের একজন আফিমাসক্ত হয়ে পড়েছিল। আফিম নিয়ে কোম্পানির সাথে চীন দুইবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং পরাজিত হয়।
ভারতে কোম্পানির প্রধান উদ্দেশ্য বাণিজ্য হলেও, বাণিজ্যের স্বার্থে তারা কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। এমনকি শেষ পর্যন্ত এক'শ বছর ধরে একটা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান বৃহৎ একটি রাজ্য চালিয়েছে।
বোম্বে মাদ্রাজ কলকাতার মতো ব্যবসায় নগরী আর পৃথিবীর বৃহত্তম রেল নেটওয়ার্ক, আধুনিক কিছু ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করলেও কোম্পানি লুটপাট করেছে প্রচুর। পলাশীর যুদ্ধের পর প্রচুর পরিমাণে সম্পদ ইংল্যান্ডে ড্রেন করা হয়।
সবশেষে বলবো ভারতে কোম্পানির আগমনের সুবিধা অসুবিধা দুইই ছিল। ব্যবসায় বাণিজ্য প্রসারের জন্য তাদের প্রণীত কিছু আইন যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোম্পানি আসার আগে ব্যবসায়িক ঝামেলা নিষ্পত্তিবিষয়ক আদালত বা আইন খুব কমই ছিল। আবার কোম্পানির অসাধু কর্মকর্তার কারণে একদিকে যেমন ভারতের অনেক শিল্প ধ্বংস হয়েছে, অন্যদিকে, শিল্পবিপ্লবের সুবিধা নিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
0 Comments