পারস্যে

 পারস্যে

১৯৩২ সালে পারস্যরাজ্যের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ বয়সে পারস্য বা আজকের ইরান ভ্রমণ করেন। সত্তরোর্ধ্ব কবি শারীরিকভাবে তখন অনেকটাই ভেঙে পড়েছেন কিন্তু পারস্যরাজের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারলেন না। বেরিয়ে পড়লেন পারস্যভ্রমণে। রবীন্দ্রনাথের সম্ভবত এটাই প্রথম বিমানভ্রমণ। বিমানভ্রমণের অভিজ্ঞতা তিনি লিখেছেন "পারস্যে" ভ্রমনকাহিনীতে। নৌকার পালের সাথে বিমানের তুলনা করতে গিয়ে এক জায়গায় লিখেছেন, নৌকার পালে বায়ুকে মেনে চলতে হয় কিন্তু বিমান বায়ুকে পীড়ন করে ওড়ে। 




ভারতের জন্য কিংবা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বাঙালির জন্য রবীন্দ্রনাথ এক অসামান্য প্রতিভা। শুধু কবিতা, গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ-নাটক বা অন্যান্য সাহিত্যের জন্য নয়। যদি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নন-স্টেট ফ্যাক্টর ধরা হয় তাহলে বলা যায় রবীন্দ্রনাথ তাই-ই। বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের এক সেতুবন্ধন। কিন্তু তার চেয়েও ভারতের জন্য রবীন্দ্রনাথ এক বিরাট সম্পদ এ কারণে যে তিনি পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করে সে সব দেশের ভালো কিছুকে গ্রহণ করতে চেয়েছেন। ভারতবর্ষের সাথে সেসব দেশের তুলনা করেছেন। দারিদ্র্য-পীড়িত রুগ্ন পরাধীন ভারতবর্ষ রবীন্দ্রনাথের জন্য সারাবিশ্বে সম্মানিত হয়েছেন। 


ফিরে আসার সময় বেদুইন সর্দার বলেছিলেন, "আমাদের আদিগুরু বলেছেন যার বাক্যে ও ব্যবহারে বিপদের আশঙ্কা নেই তিনিই যথার্থ মুসলমান"। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এই কথা শুনে যেন চমকিয়ে উঠলাম। 


কবি পারস্যে গিয়ে দেখলেন পাহলবি বংশের রাজত্বে ইরান পুরোদ্যমে উন্নয়ন করে চলছে। ইরানের একটা বিষয় তিনি ভারতবর্ষে প্রচলনের জন্য সরাসরি বলেছেন। তিনি দেখলেন ইরানে মোল্লাদের পরীক্ষা দিয়ে পাস করে সার্টিফিকেট নিতে হয় এবং তারপরেই মোল্লা-পরিচ্ছদ ধারণ করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ভাবলেন ভারতবর্ষে এমন বহু সাধু সন্ন্যাসী রয়েছে কিন্তু তাদের পরীক্ষা দিয়ে সাধুগিরি করতে হয় না।


এটা ঠিক যে সাধুতা একান্ত নিজস্ব ব্যাপার; পরীক্ষা পাশের ব্যাপার না। কিন্তু যদি সে সাধু বা পুরোহিত সেটাকে পেশা হিসেবে কিংবা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্যে হয় তাহলে পরীক্ষা পাস একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এতে ভণ্ড সাধু কমে যাবে। 


সুপ্রাচীনকাল থেকে পারস্য এক সংগ্রামী জাতি। কতবার যে বিদেশি শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে তার ঠিক নেই। এবং এই বর্তমান সময়েও যদি দেখা হয় তবুও দেখা যাবে পৃথিবীর মধ্যে ইরান-ই এখন পর্যন্ত বিদেশি শক্তি দ্বারা আক্রান্ত। তবুও ইরান বা পারস্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো ইরান টিকে আছে। টিকে আছে বললে ভুল হবে। দোদ্রোপ প্রতাপে টিকে আছে। ইরানের এই শক্তির পেছনে প্রধান নিয়ামক হলো ইরানের ঐক্য। সেখানে যে বিভিন্ন ধর্ম এবং বর্ণের লোক নেই তা নয় কিন্তু পেহলবির নেতৃত্বে তা সাম্প্রদায়িকতা একেবারে কমে এসেছে। এই যে ঐক্য সেটাই ভারতবর্ষে নেই। এখানে যে দুটি প্রধান ধর্মের লোক আছে তারা অনেকটা পিঠে পিঠ লাগানো যমজ ভাইয়ের মত। একজন এক দিকে পা ফেললে অন্যজন অপর দিকে পা ফেলায়। 


ভারতবর্ষে কীভাবে ঐক্য আনা যায় সে চিন্তা করতে করতেই তিনি কবি হাফিজের একখানি কবিতার বই খুললেন এবং যে পৃষ্ঠা বের হলো সেখানে তিনি দেখতে পেলেন এমন সাম্প্রদায়িকতা ঈশ্বরের ইচ্ছায় একসময় থাকবে না। কবি চমৎকৃত হলেন।


তিনি সেখানে বক্তৃতা রাখতে গিয়ে বলছিলেন একসময় বঙ্গাধিপতি গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (রাজার নাম উল্লেখ নেই) কবি হাফিজকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কবি সেদিন যেতে পারেননি। আজ পারস্যরাজ্যের আমন্ত্রণে সেই বঙ্গেরই এক কবি তাঁর সমাধিতে এসেছেন। 


তিনি শেখ সাদীর সমাধিতেও গিয়েছিলেন। ইরানের বিখ্যাত শিরাজ শহরের অপরূপ বর্ণনা আছে ভ্রমনকাহিনীতে। তাঁর আগমন উপলক্ষে সেদিন শিরাজের গভর্নর শিরাজে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছেন। চিন্তা করা যায় পরাধীন দারিদ্র্য-পীড়িত ভারতবর্ষের এক কবির জন্য কত আয়োজন! 


ইরানের বুশেয়ার, ইস্পাহান, শিরাজ, তেহরান সহ আরও অনেক শহরের বর্ণনা আছে। ইরানের ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে। একসময় ব্রিটিশ এবং রাশিয়া মিলে যে ইরানকে ভাগাভাগি করে নিতে চেয়েছিল এবং পাহলবির কারণে যে তা পারেনি তাও স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করেছেন।  ইরানের মানুষের, কবি সাহিত্যিকদের বর্ণনা আছে। ইরানের লোকজন তাঁকে মরমি কবি হিসেবে আপনার লোক মনে করেছেন। 


পারস্য থেকে ইরাকের রাজার আমন্ত্রণে সফরের শেষের দিকে তিনি ইরাক ভ্রমণ করেন। ইরাকের এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি একান্ত আলাপে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ব্রিটিশদের আপনি কেমন দেখেন? রবীন্দ্রনাথ প্রত্ত্যুরে বলেছিলেন, ব্রিটিশদের মধ্যে যারা বেস্ট তারা মানবজাতির মধ্যে বেস্ট। প্রশ্নকর্তা পুনরায় বলেছিলেন, আর নেক্সট বেস্ট। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন নেক্সট বেস্ট বলতে গেলে ভাষা অসংযত হবে। এই নেক্সট বেস্টরাই সমস্ত এশিয়া জুড়ে কলোনিগুলো চালাচ্ছে। 


ইরাকের একটা মেয়েদের স্কুলে তাঁকে পরিদর্শনে যেতে হয়েছিল। ইরাকের মেয়ে শিক্ষার্থীরা তাঁকে তাঁর একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতে বলে। বৃদ্ধ কবির এত কবিতা মনে থাকার কথা না। তিনি "সোনার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে" কবিতাটি আবৃত্তি করেন। 


আরব নেতাদের সভায় বক্তৃতাকালে তিনি বলেছিলেন একসময় অর্ধপৃথিবী শাসন করেছে আরবরা। ভারতবর্ষেও তাঁদের শাসন বিস্তৃত ছিল। এখন রাজ্যশাসনের আকারে না হলেও বিদ্যা এবং ধর্মের আকারে আরবরা ভারতবর্ষে রয়ে গেছে। ধরে নেন আমি তাদের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছি। আপনারা আরব সাগর পেরিয়ে সেই ভারতবর্ষের দিকে আরেকবার নজর দেন। ভারতের হানাহানি, বিভেদ যাতে কমে আসে সে চেষ্টা করেন। 


আরব বেদুইনের বাড়িতে তাঁকে একবেলা আহার করার নিমন্ত্রণ ছিল। শরীরের যে অবস্থা তাতে তিনি যেতে পারবেন না এমন মনস্থিত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর মনে পড়ল, ত্রিশ বছর বয়সে তিনি লিখেছিলেন, "হতেম যদি আরব বেদুইন"। সে কথা মনে উঠতেই তিনি বেদুইন-সর্দারের বাড়িতে গেলেন। সেখানে তাঁদের গান শুনলেন, নাচ দেখলেন এবং বৃহৎপাত্রে আস্ত এক রান্না-করা-ভেড়া-সমেত আহার করলেন। আহারের সময় তাঁর মনে হলো তিনি সেই নদী-নালা খাল-বিলের এক দেশ থেকে এই মরুভূমি মধ্যে এক বেদুইনের গৃহে আহার করছেন। দুজনের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এই দুজনের মধ্যে যে যোগ তা হলো মনুষ্যত্ব। 


ফিরে আসার সময় বেদুইন সর্দার বলেছিলেন, "আমাদের আদিগুরু বলেছেন যার বাক্যে ও ব্যবহারে বিপদের আশঙ্কা নেই তিনিই যথার্থ মুসলমান"। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এই কথা শুনে যেন চমকিয়ে উঠলাম। 


বিদায়ের সময় রবীন্দ্রনাথ বেদুইন-সর্দারকে বললেন, বেদুইনের আতিথ্য তো পেলাম। তা জগতবিখ্যাত সন্দেহ নেই কিন্তু বেদুইনের দস্যুতার খোঁজ তো পেলাম না। বেদুইন সর্দার বললেন, বেদুইন কোনো প্রাচীন জ্ঞানীলোকের গায়ে হস্তক্ষেপ করে না। 


অসাধারণ এক ভ্রমণকাহিনী। ইরান এবং আরবের সে সময়ের মানুষের চিন্তা বিশ্বাস ধ্যান ধারণা আতিথেয়তা ঐক্য প্রভৃতি জানতে বইটি এক অসাধারণ দলিল। 


রবীন্দ্রনাথ সারাবিশ্ব থেকে যে সব জ্ঞান আহরণ করে এনেছিলেন তার কিছু অংশ যদি আজকের ভারত কিংবা বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারত তাহলে এই দুই দেশের চেহারা পাল্টে যেত। কিন্তু সে কালে কংগ্রেস যেমন ভেবেছে কবিরা এমন বলে থাকে; এখনকার রাস্ত্রনায়কেরাও তাই বলে থাকেন কবিদের কথায় কি দেশ চলে। কিন্তু কবি রবীন্দ্রনাথের একটা সত্তা― প্রধান সত্তা। কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে এ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের মতো চিন্তা করার লোকও ভারতবর্ষে খুব কম জন্মেছে। যদি হিসেব করা হয় তাহলে বলা যায় গৌতম বুদ্ধের পরে রবীন্দ্রনাথের মতো এমন মহীরূহ ভারতবর্ষে নেই। দুঃখের বিষয় তাঁকে কাজে লাগানো গেল না।

Post a Comment

0 Comments