বুক রিভিউ: দ্যা ব্লুয়েস্ট আই

 বুক রিভিউ: দ্যা ব্লুয়েস্ট আই

লেখিকা: টনি মরিসন


যে বছর পিকোলা তার বাবার সন্তান গর্ভে ধারণ করে সে বছর ওহাইহোর লরেইন শহরে একটাও মেরিগোল্ড ফোটেনি। ক্লডিয়া এবং ফ্রিডা দুইবোন বাইসাইকেল কেনার জন্য সঞ্চিত টাকা দিয়ে মেরিগোল্ডের বীজ কিনেছিল এবং আশা করেছিল যদি চারা জন্মে তাহলে পিকোলার সন্তান বাঁচবে। সে বছর লরেইন শহরে একটাও মেরিগোল্ড জন্মেনি। পিকোলার সন্তানটিও বাঁচেনি। লরেইনের লোক চেয়েছিল পিকোলার সন্তানটি যেন না বাঁচে। ব্যতিক্রম ছিল ক্লডিয়া এবং ফ্রিডা। পিকোলা তাদের বন্ধু।


পিকোলার মদ্যপ বাবা কোলি ব্রিডলাভ যেবার তাদের বাড়ি আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল সেবার কিছুদিন পিকোলা ক্লডিয়া এবং ফ্রিডাদের বাসায় কিছুদিন ছিল। মিতভাষী, নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা স্বভাবের পিকোলার ক্লডিয়াদের বাসায় পিরিয়ড হয়। ক্লডিয়া এবং ফ্রিডা তাকে সাহায্য করে। ক্লডিয়া ফ্রিডা পিকোলার খুব ভালো বন্ধু। একদিন যখন ক্লডিয়া ফ্রিডা মেরিন পিল নামের আধাফর্সা দেমাগী ক্লাসমেট মেয়েটার সাথে বাসায় ফিরছিল তখন তারা কালো কুৎসিত দুর্বল স্বল্পভাষী পিকোলা মেয়েটিকে উত্যক্ত করতে দেখে কিছু ছেলেকে। এবং তাদের হাত থেকে পিকলাকে বাঁচায়। 


 পিকোলা সুন্দর ছিল না। না, কুৎসিত ছিল। সাথে দরিদ্র। তার পরিবারে তার মা-বাবা সর্বক্ষণ ঝগড়াঝাটি করত। তার বাবা কোলি ব্রিডলাভের জন্মের সময় তার মা আবর্জনার মধ্যে ফেলে আসতে চেয়েছিল। কোলির মায়ের এক আন্টি তাকে উদ্ধার করে এবং লালন-পালন করে। কোলি তার মাকে দেখেনি; বাবাকে দেখেছিল একবার ম্যাকন শহরে এক জুয়ার আসরে। তখন তার নানী, জিমি আন্টি, যিনি তাকে বড়ো করেছিল তিনি মারা গেছেন আর কোলি হয়েছে মুক্ত। পৃথিবীর কারো কাছে তার জবাবদিহিতা করার কিছু নেই। জিমি নানীর মৃত্যুর ভোজসভায় ডারলিনের সাথে পরিচয়। এবং সেই সন্ধ্যার কথা সে ভোলে না যে সন্ধ্যায় ডারলিনের সাথে আঙুর ক্ষেতে সঙ্গমের সময় তিন সাদা চামড়ার লোক তাদের দিকে টর্চ ধরে রেখেছিল এবং বলেছিল, কিছুই করতে পারবি না নেগ্রো। কোলির মধ্যে এই না পারা বা অক্ষমতা যা সে সাদা চামড়ার মানুষদের কাছ থেকে শুনেছিল তা তাকে বারবার পীড়া দিয়েছে। 


পিকোলার মা পলিন ব্রিডলাভ চৌদ্দ ভাইবোনের মধ্যে দ্বাদশ। অভাবের সংসারে সবাই কর্মব্যস্ত হোক কিংবা অধিক সংখ্যক সন্তানের কারণেই হোক পলিনের কোনো নিকনেম ছিল না। সে যখন এক উচ্চবিত্ত সাদা চামড়ার মানুষের বাড়িতে কাজ নেয় তখন তাকে তারা একটা নিকনেম দেয়: পলি। এক পা খোরা সামনের দাঁত ভাঙা পলিন সাদা চামড়ার ধনী পরিবারে একনিষ্ঠ হয়ে কাজ করে শুধু এই খুশিতে। তাছাড়া, একজন ধনী কালো মানুষের চেয়ে একজন সাদা চামড়ার বাড়ির চাকরানীর গুরুত্ব বেশি। কাজ করা এবং সিনেমা দেখা পলিনের প্রিয় অভ্যাসে পরিণত হয়। সিনেমার রোমান্টিক দৃশ্যগুলো তার ভালো লাগে। পলিন রোমান্টিসিজম বলতে সাদা চামড়ার মানুষদের প্রেম করা এবং তাদের শারীরিক সৌন্দর্য বুঝত। লেখিকা যেমনটি বলেছেন:


 "Along with the idea of romantic love, she was introduced with another– physical beauty. Probably the most destructive ideas in the history of human thought. Both originated in envy, thrived in insecurity, and ended in disillution". 


পিকোলা সেই সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানো মেয়েটি এই শারীরিক সৌন্দর্য বা ফর্সা মানেই সুন্দর এর শিকার। ইউএসএতে কালো মানেই যে শারীরিকভাবে কুৎসিত তাই না। সাদা চামড়ার মার্কিনিদের ধারণা কালো মানে তারা মনুষ্যপ্রজাতির বাইরে। তাই যখন পলিন পিকোলাকে জন্ম দিতে হসপিটালে ভর্তি হয় একদল ইন্টার্নি ডাক্তারের মধ্য থেকে একজন বলে উঠেছিল, আরে এই কালো মহিলার প্রসববেদনা নেই। এরা ঘোড়ার মতো পয়দা করে। সাদা চামড়ার মানুষদের একটা সাধারণ ধারণা কালোরা অপরাধপ্রবণ। তাই একজন সাদা চামড়ার লোক অপরাধ করলে তাকে ব্যক্তিগতভাবে দোষারোপ করা হয় কিন্তু কালোর দ্বারা সংঘটিত অপরাধকে দেখা হয় "কালোরা এরকমই করে" হিসেবে। 


এই যে কালো মানে কুৎসিত, কালো মানে অপরাধপ্রবণ, কালো মানেই খারাপ এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বড়ো হওয়া একটা পরিবারের গল্প "দ্য ব্লুয়েস্ট আই"। উপন্যাসটি ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটির লেখিকা টনি মরিসন। গল্পটিতে ১৯৪১ সালের সময়কে ধারণ করা হয়েছে। গল্পে উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলোর বঞ্চনা এবং বৈষম্যের মধ্যে দিয়ে শৈশবকে দেখানো হয়েছে। একটা কালো কুৎসিত মেয়ে স্কুলে, মহল্লায়, পরিবারে, প্রতিবেশীর বাড়িতে নিগৃহীত, অপমানিত হতে হতে নিজের মধ্যে গুটিয়ে যেতে থাকে এবং ভাবে একটা নীল চোখ তাকে এসব থেকে মুক্তি দেবে।


নীল চোখ সৌন্দর্যের প্রতীক। সে ভাবতে থাকে শারীরিক অসৌন্দর্যের কারণেই তাকে নিগৃহীত হতে হয় এবং তাই সে আকুলভাবে এক জোড়া নীল চোখ প্রত্যাশা করে। 


পিকোলার বাবা-মা একটা শৈশবট্রমার মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠেছে। তার বাবা-মাকে বইটির যে অধ্যায়ে চিত্রিত করা হয়েছে সে অধ্যায়ের নাম দেয়া হয়েছে See father big and strong এবং মাকে বলা হয়েছে see mother nice. পিকোলার বাবা নিজেকে দুর্বল এবং অক্ষম জেনে বড়ো হয়েছে আর পিকোলার মা বড়ো হয়েছে নিজেকে অসুন্দর চিন্তা করে; নিজেকে অপূর্ণ চিন্তা করে। 


পিকোলার বাবা কোলি ব্রিডলাভের নিজেকে অক্ষম এবং দুর্বল হিসেবে চিন্তা  করা কিংবা বয়ঃসন্ধিতে ডারলিনের সাথে সঙ্গমরত অবস্থায় সাদা চামড়ার মানুষের তার সম্পর্কে অক্ষম বলা, কিংবা এলকোহলিজম কিংবা অনাদরে অবহেলায় বেড়ে ওঠা একজন মানুষ যে কিনা জানে না কীভাবে সন্তান লালন-পালন করতে হয় বা সন্তানের সাথে কী আচরণ হওয়া উচিত– এর যেকোনোটি কিংবা সবকটি কিংবা কয়েকটি কারণ তাকে তার মেয়েকে ধর্ষণ করতে নিরস্ত করতে পারেনি। একবার নয়; সম্ভবত দুইবার সে পিকোলাকে ধর্ষণ করেছে এবং গর্ভবতী করেছে। 


এলকোহলিজম আমেরিকার সোসাইটিতে একটা প্রব্লেম। এটা শুধু কালো চামড়ার মানুষদের জন্যই নয়; সাদা চামড়ার মানুষ কর্তৃক নিজের মেয়েকে ধর্ষণের রেকর্ড আছে। কিন্তু কোলি ব্রিডলাভের ক্ষেত্রে এলকোহলিজমের পেছনেও কারণ আছে। Cause behind the cause. 


উপন্যাসটিতে পিকোলা নামের কালো মেয়েটির করুন পরিণতি ছাড়াও একজন মেয়ের যে সেক্সওয়াল ট্রমার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় সেটাও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটা সম্ভবত সব দেশেই আছে। মেয়েদের শরীরের প্রাইভেট পার্টের দিকে তাকিয়ে তাদের হেনস্থা করা ছাড়াও মধ্যবয়সী কিংবা পরিণত বয়সী পরিচিত কিংবা আত্মীয় দ্বারা মেয়েরা যৌন হেনস্থার শিকার হয়। গল্পের কথক নয় বছর বয়সী ক্লডিয়ার দশ বছর বয়সী বোন ফ্রিডার ক্ষেত্রে ঘটে এমন। ক্লডিয়া-ফ্রিডাদের বাসার ভাড়াটে মি. হেনরি ফ্রিডাকে হেনস্থা করে। এরকম হেনস্থা বাংলাদেশেও প্রচুর হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েরাই লজ্জায় চেপে যায়। 


যাহোক, যে বছর পিকোলার সন্তান মারা যায় এবং মেরিগোল্ড ফোটে না সে বছর পিকোলা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নিজের সাথে নিজেই কথোপকথন করে। তার মধ্যে একটা ধারণা জন্মায় সে নীল চোখ পেয়েছে এবং সেটা পৃথিবীর সবচেয়ে নীল চোখ। আর সেটা দেখে অন্যরা তাকে হিংসা করছে। মূলত অন্যরা তাকে ঘৃণা করছে নিজের বাবার সন্তান গর্ভে ধারণ করার জন্যে। 


লেখিকা শেষে বলছেন, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ তাকে ভালোবেসেছিল। ওই যে তিনজন পতিতার একজন ম্যাজিনো লাইন তাকে ভালোবেসেছিল। আর ভালোবেসেছিল কোলি ব্রিডলাভ– তার বাবা। এতটা ভালোবেসেছিল যে তাকে টাচ করেছিল। আর সে টাচ ছিল মরণঘাতী যা তাকে মৃত্যুর চেয়ে বেশি যন্ত্রনা দিয়েছিল।

 Love is never any better than the lover. Wicked people love wickedly, violent people love violently, weak people love weekly, stupid people love stupidly, but the love of free man is not safe. There is no gift for the beloved. The lover alone possesses the gift of love. The loved one is shorn, neutralized, frozen in the gulare of  the lover's in ward eye. 


উপন্যাসটি সারাবিশ্বে যেমন আলোচিত তেমনি সমালোচিত। লেখিকার সবচেয়ে বড়ো গুণ তিনি খুব ভিতরে ঢুকে সমাজের কুৎসিত চেহারাটা সামনে এনেছেন। এটা অনেকে মেনে নিতে পারেনি। উপন্যাসটিতে যৌনতার বর্ণনা থাকার কারণে ইউএসতেই বইটিকে কয়েকবার চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। সিলেবাস থেকে বাদ দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু দ্য ব্লুয়েস্ট আই-তে যেভাবে যৌনতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা কখনোই মুখরোচক বা উপভোগ্য করে নয়। বলা যায় কাহিনীর প্রয়োজনে যৌনতার অসুস্থ ভয়ঙ্কর রূপ আছে তা চিত্রিত হয়েছে। অনেকে এটাকে ইনসেস্ট বলে বাদ দেয়ার জন্য বলেছে। কিন্তু সমাজের একটা কুৎসিত অন্ধকারকে এড্রেস করতে না পারা কখনই সাহিত্যের সৌন্দর্য হতে পারে না। 


আমাদের মধ্যে সৌন্দর্যের যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে সেটা যে কী মারাত্মক ভয়াবহ হতে পারে তা এই উপন্যাসটি না পড়লে বোঝা যাবে না। একটা কথিত অসুন্দর মেয়ে আমাদের দেশেও যে কী পরিমাণ ট্রমার মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠে তা বোঝার জন্য বইটি পড়ার দরকার আছে।

Post a Comment

0 Comments