"আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী
তুমি থাকো সিন্ধু পারে ওগো বিদেশিনী......."
রবীন্দ্রনাথ গানটি লেখেন ১৮৯৫ সালে শিলাইদহতে বসে। এর ত্রিশ বছর পরে সত্যি এক বিদেশিনীর সাথে তার পরিচয় হয়। রবীন্দ্রনাথ তখন ৬৩ বছর বয়সের বৃদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুরবী কাব্যগ্রন্থটি যাঁকে উৎসর্গ করেছেন, সেই বিজয়া রবীন্দ্রনাথের সিন্ধুপারের বিদেশিনী।
১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ একবার দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে ভ্রমণ করেন। পেরুর স্বাধীনতা অর্জনের ১০০ বছর পূর্তিতে রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
পেরুতে পৌঁছানোর আগেই আর্জেন্টিনায় কবি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং বুয়েন্স আয়ার্স-এ একটি হোটেলে কিছুদিন অবস্থান করেন।
মৃত্যুর ১৩ মাস আগে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ চিঠির শেষে রোমান হরফে লিখেছেন "Bhalobasa"।
ভিকটোরিয়া ওকাম্পো তখন ল্যাটিন আমেরিকার প্রধান নারী লেখকদের মধ্যে অন্যতম। সুর নামে একটি ম্যাগাজিন চালান। তাঁর ম্যাগাজিনে সে সময়ের পৃথিবীর বিখ্যাত সব লেখক লিখতেন।
বহু ভাষায় পারদর্শী ভিকটোরিয়া ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের সাথে সেই ১৯১৪ সাল থেকেই পরিচিত ছিলেন। গীতাঞ্জলি পড়েছেন ইংরেজি স্প্যানিশ এবং ফ্রেন্স ভাষায়। এর মধ্যে ফ্রেন্স অনুবাদটাই তাঁর সবচেয়ে ভালো লেগেছে।
রবীন্দ্রনাথ বুয়েন্স আয়ার্স শহরে এসেছেন জেনে ভিকটোরিয়া রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। ভিকটোরিয়ার বয়স তখন ৩৪। রবীন্দ্রনাথের মতোই এক ধনী পরিবারে জন্ম তাঁর। রবীন্দ্রনাথের যাতে অসুবিধা না হয় তাই তিনি আলাদা একটা বাড়িতে গিয়ে তোলেন। প্লাতা নদীর তীরে অবস্থিত বাড়ির সামনের রাস্তাটা এখনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে।
ভিক্টরিয়ার সাথে অতিবাহিত করেছিলেন মাত্র দুই মাস। কিন্তু ভিকটোরিয়ার অসামান্য প্রভাব রয়ে গেছে রবীন্দ্র-জীবনে। বিশেষ করে নারী বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ভাবনায় মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
অতিবাহিত্কাল দুইমাসের হলেও ভিকটোরিয়ার সাথে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ ছিল মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। এর মধ্যে পঞ্চাশটির মতো চিঠি লেখালেখি হয়েছে। দশটি টেলিগ্রাম আদান-প্রদান হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ অনেক চিঠিতে ভিকটোরিয়াকে কলকাতায় ঘুরে যাওয়ার জন্য বলেছেন। কিন্তু ভিকটোরিয়া আসার সময় পাননি। মৃত্যুর ১৩ মাস আগে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ চিঠির শেষে রোমান হরফে লিখেছেন "Bhalobasa"।
"পুরবী" কাব্যের ২৯ টা কাব্য ভিকটোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে লেখা। উৎসর্গও করেছেন ওকাম্পোকে। কিন্তু ওকাম্পোর নাম প্রকাশ করেননি। বিজয়া নামে একজনকে উৎসর্গ করেছেন। এবং চিঠিতে লিখেছিলেন, কেউ জানতে পারবে না বিজয়া কে।
রবীন্দ্রনাথ প্যারিসে তাঁর আঁকা কিছু চিত্রকর্মের প্রদর্শনী করেন। প্রদর্শনীর আয়োজনে ওকাম্পোর ভূমিকা ছিল অসামান্য। তিনিই সব আয়োজন করে দিয়েছিলেন। প্যারিস প্রদর্শনীর সময় ভিকটোরিয়া ওকাম্পোর সাথে তাঁর দ্বিতীয়বার দেখা হয়।
১৯৬১ সালে আর্জেন্টিনা সরকার রবীন্দ্রনাথের নামে ডাক টিকেট ছাপান। এতে ভিকটোরিয়ার অবদান রয়েছে।
বহু নারীর প্রভাবে প্রভাবিত রবীন্দ্র-জীবনে ভিকটোরিয়া ওকাম্পোর প্রভাব কম নয়। ত্রিশ বছর আগে "ওগো বিদেশিনী" নামে যে গান লিখেছিলেন সেই বিদেশিনীরই যেন তিনি খোঁজ পেলেন ল্যাটিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায়। তাই মেসি ম্যারাডোনাদের দেশ আর্জেন্টিনার সাথে বাঙালির যোগটা নতুন নয়। বহু পুরাতন।
0 Comments