খোয়াবনামা

 খোয়াবনামা 

পাকিস্তান হলে মুসলমানদের আলাদা দেশ হবে; তখন আর হিন্দু জমিদাররা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করতে পারবে না― এমন আশায় বুক-বাধা কাৎলাহার বিলের দুইপাড়ের দরিদ্র সরল বিশ্বাসী কুসংসারাচ্ছন্ন হিন্দু-মুসলমানের জীবনালেখ্যকে উপজীব্য করে রচিত উপন্যাস "খোয়াবনামা" (১৯৯৬)। ব্যাপ্তি আর পরিধির বিচারে উপন্যাসটি পেয়েছে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা। 



সিপাহি বিদ্রোহের নায়ক মজনু শাহ এবং ভবানী পাঠক এই এলাকার মানুষের কাছে পূজনীয় ব্যক্তি। এঁদেরই একজন সেনা মুনশি কাৎলাহার বিলের উত্তর সিথানে পাকুর গাছের মাথায় আসন গেড়ে বসে আছে। তাঁর ইশারায় কাৎলাহার বিলে সবকিছু হয় এমন বিশ্বাস গিরিডাঙ্গা, নিজগিরিডাঙ্গা এবং গোলারদীঘির হিন্দু-মুসলিম মানুষদের। 


সিপাহি বিদ্রোহ, দেশবিভাগ, তেভাগা আন্দোলন প্রভৃতি পটভূমি নিয়ে রচিত উপন্যাসটি। উপন্যাসটিতে ধর্মের নামে ধনিক শ্রেণির মানুষ কর্তৃক নিম্নবর্গের মানুষদের অত্যাচার, আশা ও স্বপ্ন ভঙ্গ, ঠকানো, নিজেদের স্বার্থে নিম্নবিত্তের হিন্দু-মুসলিমকে সাম্প্রদায়িকতায় উস্কে দেয়া, সেসময়ের মানুষের চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, কুসংস্কার সবকিছুই আছে। 


এ উপন্যাসে জাদুবাস্তবতা আমার কাছে মনে হয়েছে মার্কেজের হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউডের কাছাকাছি। আছে ফ্রয়েডিজমের বাস্তব প্রয়োগ। 


স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস "খোয়াবনামা"। এর মান মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "পুতুলনাচের ইতিকথা"র সমান। লেখকের চিল-তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ, অন্তর্দৃষ্টি, ক্লাইম্যাক্স সৃষ্টির ক্ষমতা, ইতিহাস-নিষ্ঠতা, ঐতিহাসিক বাস্তবতার প্রয়োগের সার্থকতা, আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার, নিরপেক্ষ ও নিরাবেগ দৃষ্টিভঙ্গি উপন্যাসটিকে কালজয়ী করে তুলেছে। 


একান্তই ব্যক্তিগত অভিমত: উপন্যাসটি ইংরেজি, ফরাসি বা স্প্যানিশ ভাষায় রচিত হলে এটি হতো বিশ্বের সেরা বইগুলোর মধ্যে একটি। 


ক্ষণজন্মা লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস(১৯৪৩-১৯৯৭)  অনবদ্য সৃষ্টি খোয়াবনামা প্রকাশের এক বছর পরেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। দুই বাংলায় একই বছর প্রকাশিত উপন্যাসটি প্রকাশের বছরেই আনন্দ পুরস্কার পায়। 


শহিদুল জহির বাংলা সাহিত্যের আরেকজন খ্যাতিমান পুরুষ। শহিদুল জহিরের ওপরে আখতারুজ্জামান ইকিয়াসের রয়েছে গভীর প্রভাব। আগে শহিদুল জহির পড়া আছে বলে খোয়াবনামা পড়তে গিয়ে বারবার সে কথাই মনে হয়েছে। 


আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যে দেশের এবং ভাষার সাহিত্যিক সে দেশের এবং ভাষার সাহিত্যিকদের সৃষ্টি হবে মহান। এমন লেখক থাকলে উত্তরসূরীদের পেছনে ফিরে তাকানোর দরকার হয় না; মেধা সাহস শ্রম প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে গেলেই হয়।

Post a Comment

0 Comments