সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙল কেন
১৯৯১ সালের আগস্ট মাস। রাশিয়াতে তখন শীত শুরু হয়েছে। মিখাইল গর্বাচেভ ক্রিমিয়ার দক্ষিণে ইয়াল্টার নিকট একটি দাচায় (বিশ্রামের জন্য নির্মিত বাড়ি) অবকাশ যাপন করছেন।
মস্কোর খবর ভালো না তিনি আঁচ করতে পেরেছেন। মস্কোতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সতর্ক করে দিয়েছেন তাঁকে।
কিন্তু গর্বাচেভ তাঁকে কিছু বুঝতে না দিয়ে হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ভিতর থেকে একটা শঙ্কা তার মধ্যে কাজ করছে।
যে আগস্টের কথা বলছি সে আগস্টে সোভিয়েত ইউনিয়নে তিনটি আঁতাত ফ্রন্ট লাইনে চলে এসেছে। এর মধ্যে রক্ষণশীল আঁতাতটি কমিউনিজমকে টিকিয়ে রাখতে চায়। এই আঁতাতের নেতৃত্বে আছেন কেজিবি প্রধান ভ্লাদিমির ত্রুচকেভ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী দিমিত্র ইয়াজভ, কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি সহ মোট এগারো জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
অন্য একটি আঁতাত যারা পুঁজিবাদকে সমর্থন করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের আমূল সংস্কার চান তাদের নেতৃত্বে আছে ইয়ালেৎসিন।
আর তৃতীয় আঁতাতটি হলো গর্বাচেভের নেতৃত্বে তুলনামূলক মডারেট আঁতাত। এরা সোভিয়েত ইউনিয়নকে টিকিয়ে রেখে সংস্কার চান। পেরেস্ত্রইকা এবং গ্লাসনস্ত এই আঁতাতের নীতি।
৯১'র আগস্টের ১৭ তারিখে রক্ষণশীল আঁতাতটি একটি ক্যু করে। গর্বাচেভকে ইয়াল্টাতেই গৃহবন্দি করা হয়। মস্কোর সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ। অন্যদিকে, ইয়ালেৎসিনসহ সংস্কারবাদী আঁতাতকে গ্রেফতারের সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ। মস্কোর লিফোরতোভিস্ক কারাগার খালি করা হয়েছে। দুই লক্ষ হ্যান্ডকাপ অর্ডার করা হয়েছে।
কিন্তু ক্যু ব্যর্থ হলো। মস্কোর রাস্তায় ইয়ালেৎসিনের সমর্থনে মানুষ আর্মি পুলিশ কামান উপেক্ষা করে নেমে পড়লো। ইয়ালেৎসিন অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে রাশিয়াকে স্বাধীন ঘোষণা করলেন। তাঁকে দেখে বাল্টিকের তিন কন্যা: এস্তোনিয়া, লিথুনিয়া, লাটভিয়াও সহ স্বাধীনতা ঘোষণা করল অন্য ১৪ টি রাষ্ট্র।
একই বছর ২৫ ডিসেম্বর গর্বাচেভ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন। পরের বছর ২ জানুয়ারি, এক আদেশ বলে ইয়ালেৎসিন ৭৫ বছরের পুরাতন পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বাতিল করলেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে ফ্রাংকিস ফুকুয়েমা লিখলেন দি এন্ড অফ দ্যা হিস্ট্রি এন্ড লাস্ট ম্যান। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে একটি প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। বলশেভিক বিপ্লব কি তাহলে একটি ঘটনা মাত্র। আর ৭৫ বছর ধরে সমাজতন্ত্র টিকে থাকার রহস্য কি শুধুই জোর জুলুম?
এটা সত্য কার্ল মার্ক্স পুঁজিবাদের চরম পরিণতির ফলস্বরূপ সমাজতন্ত্রের যে কথা বলেছেন জারের অধীন রাশিয়া তেমন ছিল না। রাজার অন্যায় অত্যাচার ছিল। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য পুঁজিবাদের চরম অবস্থা তৈরি হয়নি।
১৯১৭ সালের মার্চে বুর্জোয়াদের দ্বারা জার নিকোলাস-২ উৎখাত হওয়ার পরে ভিআই লেনিনের নেতৃত্বে অক্টোবর মাসে বলশেভিক বিপ্লব ঘটে।
৭৫ বছর ধরে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সভ্যতা টিকে ছিল। বিশ্বে এই বিশাল সভ্যতার প্রভাব অনেক। প্রথম দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এত উন্নতি করেছে যে পশ্চিমা বিশ্বও অবাক হয়ে যায়। শিক্ষা কৃষি শিল্প উৎপাদনে অভূতপূর্ব উন্নতি। কিন্তু অর্থনীতি যত দ্রূত এগিয়েছে, সমাজ এবং সংস্কৃতি তত দ্রুত এগোতে পারেনি। সেজন্য রাষ্ট্রকাঠামোতেও সৃজনশীলতার অভাব ছিল। আর ছিল প্রচুর দুর্নীতি আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আয়ের অসম বণ্টন জনমন বিষিয়ে তুলেছিল।
এত কিছুর পরেও সোভিয়েত ইউনিয়ন টিকিয়ে রাখার অনেক সুযোগ এসেছিল। লেনিন নিজেও কিছুটা সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। কৃষিতে যৌথ খামারের বদলে ব্যক্তি মালিকানায় কিছু সম্পদ দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু লেনিনের মৃত্যুর পরে স্তালিন ক্ষমতায় এসে সবকিছু বাতিল করে দিলেন।
স্তালিনের অনেক অবদান আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি সোভিয়েতকে বাঁচিয়েছেন। বিশাল এক রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্তালিন ছিলেন একজন খুনি। কমিউনিস্ট পার্টির ১৩৯ জনের মধ্যে ৯০ জনকে তিনি গুম খুন করেছেন। অনেক রাজনৈতিক বন্দীদের দিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে তিনি রাস্তা নির্মাণ এবং খাল খনন করিয়েছেন। নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা স্তালিনের বাম হাত পঙ্গু ছিল। সেটা তিনি আজীবন লুকিয়ে রাখতে চেয়েছেন। এমনকি পিতার পরিচয়ও তিনি দিতেন না। মায়ের খোঁজ খবর রাখতেন খুব কম।
স্তালিনের পরে তুলনামূলক কম আগ্রাসী আসেন ক্রুশ্চেভ। তিনি কিছুটা সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রেজনেভ এসে সব ধরনের সংস্কার বন্ধ করে দিলেন। ব্রেজনেভের পর গর্বাচেভ। গর্বাচেভ উদারনীতি গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। সোভিয়েতের মানুষ সংস্কার চাইলেও বেশিরভাগ মানুষের আস্থা ছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের প্রতি। তবুও শেষরক্ষা হয়নি।
অনেকগুলো কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের।
বিপ্লবের মাধ্যমে সামাজিক মুক্তি ও সমাজিক পুনর্গঠন সম্ভব নয়। সম্ভব হলেও ফলাফল সামান্য। রাশিয়ার বিখ্যাত লেখক: দস্তয়েভস্কি, লিও তলস্তয়, চেখব বিপ্লবের ঘোর বিরোধী ছিলেন। বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কি বিপ্লববিরোধী ছিলেন না? চার অধ্যায় এবং ঘরে বাইরে উপন্যাসে বিপ্লবকে সরাসরি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
সোভিয়েত পতনের দ্বিতীয় কারণ হলো, ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে উপেক্ষা করা। প্রত্যেক জাতির একটা নিজস্বতা আছে। নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্য আছে। এটাকে স্বীকার করতে না পারলে ভুল হবে।সোভিয়েত ইউনিয়ন রাশিয়ার সেই ইতিহাস ঐতিহ্যকে জোর করে অস্বীকার করে সেখানে কমিউনিস্ট আদর্শ চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল।
পতনের আরেকটি বড়ো কারণ হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশাল আয়তন। শুধু আয়তনই না। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন জাতিসত্ত্বা। এই বৃহৎ আয়তন আর বিবিধ জাতিসত্ত্বাকে একই লক্ষ্যের দিকে নিয়ে আসা খুবই দুরূহ ব্যাপার।
চতুর্থ কারণ হলো, কমিউনিস্ট নেতা এবং আমলাদের মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতি।
তাছাড়া, সোভিয়েতের শিক্ষিত জনগণ ইউরোপীয় দর্শন এবং ভাবধারা দ্বারা অনেক বেশি অনুপ্রাণিত ছিল। ইউরোপে তখন গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে তার বিপরীত চিত্র। সেজন্য মানুষ সংস্কারের জন্য মুখিয়ে ছিল। কিন্তু কমিউনিস্ট নেতৃবর্গ সেটা উপেক্ষা করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করেছে।
সবশেষে বলবো, রাষ্ট্রের সাফল্য রাষ্ট্রের আদর্শ যেমন: সমাজতন্ত্র বা পুঁজিবাদ- এর চেয়ে শাসক বা শাসকবর্গের নৈতিক চরিত্রের ওপর বেশি নির্ভর করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্ভবত ওই জায়গাতে ব্যর্থ হয়েছে। সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ অধিক মাত্রায় ক্ষমতালিপ্সু ও ভোগবিলাসী হয়ে উঠেছিলেন।
"সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙল কেন" বদরুল আলম খানের একটি অসাধারণ বই। লেখক ১৯৭২ সালে সোভিয়েত সরকারের বৃত্তি নিয়ে মস্কোতে পড়তে যান। সেখানে প্রায় বারো বছর কাটিয়েছেন। বইটিতে আছে রুশ জাতির উৎপত্তি, রুশ ভাষার উৎপত্তি, রুশ সাহিত্য, রুশ মানুষের জীবনযাত্রা, রুশ শিল্প ও সংস্কৃতি, রুশ ঐতিহ্য-ইতিহাস, রাশিয়ার মিউজিয়াম, রাশিয়ার ভূপ্রকৃতি প্রভৃতি সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা। বইটা এক প্রকার ভ্রমণকাহিনীও। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং রাশিয়া সম্পর্কে জানার জন্য বইটা অনবদ্য।
0 Comments