চিলেকোঠার সেপাই

 চিলেকোঠার সেপাই

"পদ্মানদীর মাঝি" না "পুতুল নাচের ইতিকথা" কোনটি মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ রচনা তা নিয়ে যেমন ভিন্ন ভিন্ন মত থাকতে পারে তেমনি "চিলেকোঠার সেপাই" না "খোয়াবনামা" কোনটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের শ্রেষ্ঠ রচনা তা নিয়েও মতের ঐক্য নেই।


ক্ষণজীবী ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) এক দশকের ব্যবধানে লিখেছেন মাত্র দুইটি উপন্যাস: চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৬) আর খোয়াবনামা (১৯৯৬)। এর আগে ছোটগল্প লিখেছেন কিছু। তাঁর ছোটগল্পগুলোও বাংলাসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। 


পূর্ববঙ্গের হিসেবে বাংলা কথা সাহিত্যের আধুনিক পুরুষ সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ। তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী যদি কেউ থাকেন নির্দ্বিধায় তিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ কর্তৃক নির্বাচিত গত শতাব্দীর দশটি শ্রেষ্ঠ মানবিক বইয়ের তালিকায় খোয়াবনামা রয়েছে। 


সাহিত্যে পাকাপোক্ত জায়গা করে নেওয়ার জন্য সম্ভবত খুব বেশি লেখার প্রয়োজন পড়ে না। ইলিয়াসের দুইটা উপন্যাস আর কয়েকটি ছোটগল্প তার প্রমাণ। 


চিলেকোঠার সেপাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এক মহাকাব্যিক উপন্যাস। উপন্যাসটির বিষয়বস্তু ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান হলেও উপন্যাসটিতে একটা সময়ের শোষিত বঞ্চিত নিগৃহীত গ্রামের নিম্নবিত্ত মানুষের এবং শহুরে রাজনীতি সচেতন মানুষের চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস প্রভৃতি ফুটে উঠেছে। 


ইলিয়াসের দুইটি উপন্যাসেরই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর উপন্যাস বৃহৎ ক্যানভাসে আঁকা বহু চিত্রের সমষ্টি। আলোচ্য চিলেকোঠার সেপাইতেও তাই চোখে পড়ে। শহুরে নিঃসঙ্গ ওসমান মৌলিক গণতন্ত্রী রহমতুল্লাহর বাড়ির চিলেকোঠায় ভাড়া থাকেন। একই বাড়িতে থাকেন মকবুল মিয়া, ভীতু লোকটার জ্যেষ্ঠ পুত্র আবু তালেব পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। উপন্যাসের শুরুতেই তার বর্ণনা আছে।


আবু তালেবের ভাই রঞ্জু। রঞ্জু ওসমান শেখের ডাকনামও। রঞ্জুর বোন রানু। শ্যামলা রানুর প্রতি ওসমান যৌনাসক্ত যেটি খুবই স্বাভাবিক। 


ওসমানের বন্ধু আলতাফ আওয়ামীলীগার। আনোয়ারের সাথে তার তর্ক বিতর্ক লেগেই থাকে। আনোয়ার ওসমানের বন্ধু। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এক উদ্যোমী তরুণ। বিপ্লব ঘটানোর প্রত্যয় নিয়ে গ্রামে গিয়ে ব্যর্থ হলেও টলে না। খয়বার গাজী আর তার ভাস্তে আফসার গাজীর মতো ধুরন্ধর লোকের কাছে সরলমনা আনোয়ার পরাজিত হয়। ভুল বোঝে বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী সতীর্থ আলী বক্স। গ্রামের চেংটু, নাদু প্রামাণিক, করমালি, জালাল মাস্টার চরিত্রগুলো  গ্রামের সাথে ঠিকঠিক মিলে যায়। কোথায় বেখাপ্পা লাগে না। 


বহু চরিত্রের বৃহৎ ক্যানভাসে প্রতিফলিত ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান শুধু শহরেই ঘটে না। গ্রামের মানুষের অবদানও স্বীকৃত হয়। স্বীকৃত হয় বস্তিবাসীর নিম্নবর্গীয় মানুষের অবদানও। উপন্যাসটিতে পিতৃপরিচয়হীন বস্তিবাসী খিজির আলী সম্পূর্ণটা জুড়েই ছিল। 


প্রেক্ষাপট ছাড়াও ইলিয়াসের উপন্যাসের ভাষাগত গাঁথুনি অসাধারণ। ঢাকাইয়া মানুষের সংলাপে ঢাকার আঞ্চলিক ভাষা, যমুনা পাড়ের মানুষের সংলাপে যমুনা পাড়ের মানুষের ভাষা, শিক্ষিত মানুষের সংলাপে প্রমিত বাংলা ভাষা ও ইংরেজি ভাষার স্বার্থক প্রয়োগ ঘটেছে। 


কাহিনী সৃষ্টিতে চরিত্রগুলোর মনের মধ্যে  উপচে পড়া চিন্তার সমাগম চোখে পড়ে। একই সাথে বহু কিছুর চিন্তা লেখক দক্ষ শিল্পীর ন্যায় একই সরলরেখায় সাবলীলভাবে বর্ণনা করে চলেছেন। 


আর আছে স্ল্যাংয়ের ব্যবহার। স্ল্যাং, কথ্যভাষা আর কৌতুকের স্বার্থক প্রয়োগ উপন্যাসটিকে একঘেয়ে হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। 


একই চরিত্রের ভালো-মন্দ দিকগুলো এমনভাবে ফুটে উঠেছে যে সেটা হয়ে উঠেছে খুবই স্বাভাবিক আর প্রাত্যহিক। কোনো চরিত্রই লেখকের ব্যক্তিগত চিন্তা বিশ্বাস বা দর্শনের কারণে পক্ষপাতিত্বমূলক হয়ে ওঠেনি। 


উপন্যাসটি ঐতিহাসিক হলেও একটা সময়কে, একটা সময়ের মানুষের চিন্তাভাবনাকে ধারণ করা হয়েছে। কোনো কার্পণ্য নয়, কৃত্রিমতা নয়। যা সত্য তাই ফুটে উঠেছে। 


সর্বোপরি বল যায়, চিলেকোঠার সেপাই দেশ এবং কালের গণ্ডি পেরিয়ে সর্বজনীন হয়ে উঠেছে।

Post a Comment

0 Comments