রবীন্দ্রনাথ ও মুসলিম সমাজ

 রবীন্দ্রনাথ ও মুসলিম সমাজ

ভুঁইয়া ইকবাল



রবীন্দ্রনাথের সব সাহিত্যকর্মে মুসলিম চরিত্র উঠে এসেছে মাত্র সাতটি। তাঁর যে সব সাহিত্যকর্মে মুসলিম চরিত্র রয়েছে তা শতাংশে হিসেব করলে মোট সাহিত্যকর্মের দশ শতাংশের কম হবে। অথচ রবীন্দ্রনাথ যে সময় জীবিত ছিলেন সে সময় বাংলায় মুসলিম ছিল ৫৪% এর বেশি। তার মানে তিনি বৃহৎ এক মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অবহেলা করেছেন। তবে, তাঁর সাহিত্যকর্মে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রতিনিধিত্বও হতাশাজনক ভাবে খুবই কম। 



গল্প-উপন্যাসের চরিত্র সৃষ্টি দিয়ে বিবেচনা করলে বলা যায় রবীন্দ্রনাথ একজন সাম্প্রদায়িক লোক― এমন ধারণাই আমরা করে থাকি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বাঙালি অবাঙালি মিলে অন্তত এক'শ জন বিশিষ্ট মুসলিমদের সাথে একাধিকবার চিঠি-পত্রে যোগাযোগ রেখেছেন। 


এবার বইমেলায় #প্রথমা প্রকাশনীতে একটা বই চোখে পড়ল। বইটি প্রথম মুদ্রিত হয় ২০১৫ সালে। লেখক ভূঁইয়া ইকবাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাবিভাগের অধ্যাপক। বইটির ভূমিকা লিখেছেন ডঃ আনিসুজ্জামান স্যার। 


বইটিতে কয়েকটি ভাগ আছে। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ যে সব বিশিষ্ট মুসলিমকে চিঠি-পত্র লিখেছেন সে সব চিঠির সংকলন। সবক্ষেত্রে সমস্ত চিঠি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। সেখানে তিনি চুম্বক অংশ তুলে ধরেছেন। আরেকটি অংশে আছে বিশিষ্ট মুসলিম মনীষী কর্তৃক রবীন্দ্রনাথকে লিখিত চিঠি-পত্র। বিভিন্ন মুসলিম ব্যক্তির মৃত্যুতে বা জন্মদিনে তিনি বার্তা প্রেরণ করেছেন তার সংকলন আছে বইটিতে। 


বইটি পড়ে জানা যাবে শান্তিনিকেতনে বেশ কিছু মুসলিম শিক্ষার্থী ছিলেন। এঁদের মধ্যে সৈয়দ মুজতবা আলী একজন। তিনি স্কুলে পড়াকালীন রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সেই চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন। চিঠির উত্তর পেয়ে বালক মুজতবা আলী তাঁর পিতাকে বলেন তিনি শান্তিনিকেতনে পড়তে যাবেন। রবীন্দ্রনাথ যাঁদের কাছে সবচেয়ে বেশিবার চিঠি লিখেছিলেন তিনি কাজী আব্দুল ওদুদ। ছয়টা চিঠির খোঁজ পাওয়া যায়। আর ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কাছে লিখেছেন চারটি চিঠি। এর মধ্যে একটি কবি-পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ের নিমন্ত্রণ দেয়ার জন্য। 


পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা কবি আল্লামা ইকবাল ১৯৩৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ শোকবার্তা পাঠান। 


হযরত মুহাম্মদ (স) এর জন্মদিনে তিনি বিভিন্ন মুসলিম সভা-সমিতিতে বার্তা পাঠাতেন। তার একটি বার্তা বইটিতে পাওয়া যাবে। শান্তিনিকেতনে ইসলামী সংস্কৃতি নামে একটি বিভাগ ছিল। এটা অনেকের অজানা। এবং সেই বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন মওলানা জিয়াউদ্দিন  নামের একজন। জিয়াউদ্দিনের মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ শোকাহত হন এবং একটি কবিতা লেখেন। বইটিতে সে কবিতা স্থান পেয়েছে। 


শান্তিনিকেতনে বেশ কিছু মুসলিম পুরুষ শিক্ষার্থী থাকলেও ছিল না কোন নারী শিক্ষার্থী। বন্দে আলী মিয়া সস্ত্রীক কবির সাথে দেখা করতে গেলে রবীন্দ্রনাথ বন্দে আলী মিয়ার স্ত্রীকে বলেন, শান্তিনিকেতনে কোনো মুসলিম নারী শিক্ষার্থী নেই। আপনার বোনেদের এখানে পড়তে আসতে বলতে পারেন। 


বাঙালি মুসলিম কবিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রবীন্দ্র-অনুরক্ত ছিলেন কে শুনলে অবাক হয়ে যেতে পারেন। তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে উর্দুকে সমর্থন করেছিলেন। তিনি আর কেউ নন গোলাম মোস্তফা। 


সময়ে সময়ে মুসলিম শিক্ষার্থীরা তাঁর সাথে দেখা করতে যেতেন। তাঁরা প্রায়ই হিন্দু-মুসলিম বিরোধ নিয়ে কথা বলতেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই বিষয়টা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। এবং তিনি মুসলিম শিক্ষার্থীদের একবার বলেওছিলেন ইসলাম ধর্ম নিয়ে আমার মধ্যে কোনো বিদ্বেষ নেই। 


রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এবং মুসলিম সমাজের সাথে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে আরও জানতে বইটি পড়তে পারেন। অনেক গবেষণাধর্মী তথ্যবহুল এবং বস্তুনিষ্ঠ একটি বই। 

Post a Comment

0 Comments