আগুনপাখি
"আগুনপাখি" গল্পটা তৈরি হয়েছিল বহু আগেই। প্রকাশ পেয়েছে ২০০৬ সালে। এর আগে "অপ-রূপকথা" নামে ২০০৫ সালে প্রথম আলো ঈদ সংখ্যায় বের হয়। ছোটগল্পের রাজপুত্র খ্যাত ডায়াসপরা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক আগুনপাখির গল্পটা বহন করে চলেছেন সাতষট্টি বছর। এর আগে লিখছেন অসংখ্য ছোটগল্প। সে সব ছোটগল্পে দেশবিভাগের খণ্ড খণ্ড চিত্র উঠে এসেছে। কিন্তু দেশভাগের অখণ্ড স্মৃতি ফুটিয়ে তোলার জন্য একটা উপন্যাস দরকার ছিল।
বাংলাদেশের হাসান আজিজুল হকের সাথে কলম্বিয়ার গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের তুলনা এখানেই। মার্কেজ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনা (যদিও মার্কেজ নিজে "মোড়লের শরৎ"কে শ্রেষ্ঠ রচনা মনে করেন) "ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউড" গল্পটা ভেবেছিলেন বহু বছর আগে। কিন্তু লিখেছেন পরে।
উত্তম পুরুষে লেখা "আগুনপাখির" গল্পটা বলেছেন একজন নারী। ২২৪ পৃষ্ঠার উপন্যাসটা সম্পূর্ণ আঞ্চলিক (রাঢ়বঙ্গের) ভাষায় লিখিত। আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত বাংলাভাষায় সর্ববৃহৎ উপন্যাস হয়তো এটি। উপন্যাসের কাহিনী একজন নারীর বর্ণনায় পুরো পরিবারের উত্থান এবং বিভাজনের চিত্র ফুটে উঠেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো সময়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বল্পশিক্ষিত এক নারীর বয়ানে উপন্যাসটি প্রমিত বাংলাভাষায় লিখিত হলে অকৃত্রিমতা হারাত। আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগে লেখক শুধু সফলই নন; সাহসী-ও। কেননা, এত বড়ো প্লট আঞ্চলিক ভাষায় পাঠকের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ থেকে গিয়েছে। তাছাড়া, লেখকের সাহসিকতার পরিচয় অন্যখানে। দেশবিভাগের মতো এত বড়ো একটা বিষয় একজন স্বল্পশিক্ষিত অন্দরমহলের নারীর দৃষ্টিতে দেখানো এবং একটি পরিবার দিয়ে পুরো কাহিনী নির্মাণ কঠিন। নির্মাণ যেমন কঠিন তেমনি পারিবারিক উপন্যাসের আয়ু নিয়েও সন্দেহ থেকে যায়। তবুও "আগুনপাখি" পাঠকপ্রিয়তা পেল। প্রথম আলো বর্ষসেরা উপন্যাস-১৪১২ নির্বাচিত হলো। আনন্দপুরস্কার জিতে নিলো ২০০৮ সালে। মার্কেজের সাথে হকের তুলনা এখানেও। ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউড উপন্যাসটিও গাবো তাঁর নিজের পরিবারকে নিয়ে লিখেছেন। ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউডের উরসুলা ইগুয়ারান যেমন গাবোর মায়ের প্রতিচিত্র; আগুনপাখির গল্পকথক তেমনি হাসান আজিজুল হকের মা। উপন্যাসটি লিখতে লেখক তাঁর মায়ের কথ্যভাষাটাই বেছে নিয়েছেন। উরসুলার মতোই আগুনপাখির গল্পকথক পরিবারটিকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছে।
দেশবিভাগ এতদঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো ঐতিহাসিক ট্রমা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মানুষ ভুলে গেল; স্মৃতি থেকে ঘামের মতো মুছে ফেলল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মহামারি আর ৪৩ এর দুর্ভিক্ষ। কিন্তু হিন্দু-মুসলিম তিক্ততা রয়ে গেল রক্তে বারুদ হয়ে। এই রক্ত-বারুদই আগুনপাখি।
ইতিহাসের পাতায় সাধারণ মানুষের কথা খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই অভাবটা পূরণ করে সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যে দেশবিভাগ নিয়ে লেখা তুলনামূলক কম। উপমহাদেশে উর্দু লেখক সাদত হোসেন মানটো, খুশআন্ত সিং, সালমান রুশদি, গুলজার প্রমুখ সাহিত্যিক পাওয়া যায়। দেশবিভাগ নিয়ে সাধারণ মানুষের সাইকটা নিজের প্রত্যক্ষ দর্শন থেকে লিখেছেন যতীন সরকার "পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন" বইয়ে। তবুও সে সাধারণ মানুষ একেবারে সাধারণ মানুষ নন। সমাজের শিক্ষিত খোঁজ-খবর-রাখা পত্রিকা-পড়া মানুষেরাই। আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের "খোয়াবনামা"য় ফুটে উঠেছে সমাজের সেই উপেক্ষিত অংশের প্রতিচ্ছবি। বাইরে থেকে সাম্প্রদায়িকতা ইনডিউস করার আগে এই অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান যে ভাই-ভাইয়ের মতোই থেকেছে তা জানা যায় খোয়াবনামায়। তবুও "খোয়াবনামা"তে পুরুষের সাইকটাই ফুটে উঠেছে। দেশবিভাগের সবচেয়ে খারাপ ভুক্তভোগী নারীর কথা পাওয়া যায় আগুনপাখিতে। নারীর কর্তৃত্ব নেই। স্বামীর কথার বাইরে গিয়ে তিনি পাঁচ ভাইয়ের সংসার পৃথগণ্ন থেকে রক্ষা করতে পারেননি। তেমনি পারেননি দেশবিভাগ ঠেকাতে। তবুও তো জোর দিয়েই স্বামী-সন্তানের ক্রমাগত অনুরোধ উপরোধ উপেক্ষা করে পাকিস্তানে যাননি। শাশুড়ির কবরের স্মৃতি আশ্রয় করে রয়ে গেছেন। উপন্যাসে সারাজীবন স্বামী-সংসারের মুখাপেক্ষী নারীর হঠাৎ স্বাধীনচেতা হওয়ার দৃষ্টান্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। গল্পকথক নারীর স্বেচ্ছায় স্বভিটায় রয়ে যাওয়ার মধ্যে ফুটে উঠেছে দেশভাগ নিয়ে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি। লেখক দেশভাগ চাননি। চাননি গল্পকথকের স্বামীও যাকে তিনি কত্তা বলে পরিচয় করে দিয়েছেন। তবুও কত্তা শেষপর্যন্ত দেশভাগ মেনে নিয়ে পাকিস্তানে (পূর্বপাকিস্তানে) চলে গেলেন। কিন্তু গল্পকথকের ল দ্যাওর যিনি পাকিস্তান পাকিস্তান করে উত্তেজিত হয়েছেন, দাঙ্গায় অংশগ্রহণ করেছেন তিনি যেতে পারেননি। ইতিহাসের নির্মমতা এখানেই: যারা পাকিস্তান চেয়েছিল তাদের অনেকেই পাকিস্তানে যেতে পারেনি; আর যারা চায়নি তাদের যেতে হয়েছিল। দিল্লি উত্তর প্রদেশ আর বিহারের সেই সব মুসলমান যারা পাকিস্তানের জন্য জোরালো আন্দোলন করেছিল তাদের অনেকেই পাকিস্তানে যেতে পারেনি। অন্যদিকে, পাকিস্তানের বেলুচ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অনেক মুসলমান পাকিস্তান চায়নি কিন্তু পাকিস্তান মেনে নিতে হয়েছে। উপন্যাসের ল দ্যাওর যেন সেসব মানুষেরই প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে।
দেশভাগ নিয়ে লেখা হলেও উপন্যাসটিতে তৎকালীন সমাজের চিত্র পাওয়া যায়। বিভূতিভূষণের ইছামতি যেমন ব্রিটিশ আমলের ইছামতি পাড়ের মানুষের জীবনের ছবি এঁকেছেন, তেমনি হাসান আজিজুল হক বর্ধমান অঞ্চলের মুসলিম পরিবারের ছবি এঁকেছেন। ইছামতি আর আগুনপাখির বর্ণনা যেন একই। টান টান উত্তেজনা, ক্লাইম্যাক্স, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিকভাবে লিখে গেছেন উপন্যাসটি। আর যে বিষয়টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তা হলো আমরা বাংলাদেশের সাহিত্যে পূর্ববঙ্গের মানুষের দেশভাগের স্মৃতি পাই; সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "পূর্ব-পশ্চিম" বইয়ে খণ্ডিত আকারে কলকাতার শিক্ষিত জনদের মনোভাব বোঝা যায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু অধ্যুষিত মুসলিম পরিবারের চিত্র ফুটে উঠেছে আলোচ্য উপন্যাসে।
আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ, কাহিনী সৃজন, ইতিহাসচেতনতা এবং নির্মোহতা, আঙ্গিক কাঠামো, চরিত্র চিত্রায়ন সবকিছু মিলে উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে একটি অনন্য সংযোজন। এর আবেদন সীমাহীন।
0 Comments