যখন পুলিশ ছিলাম

 যখন পুলিশ ছিলাম


টেকনাফের মগ জমিদারকন্যা মাথিন কতটা ভালোবেসেছিল বাঙালি পুলিশযুবা ধীরাজ ভট্টাচার্যকে, তা তার করুণ পরিণতিই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে "যখন পুলিশ ছিলাম" বইয়ের পাতায়। মাথিনের করুণ পরিণতি জাতপাত আর সংস্কারের রূঢ় শৃঙ্খলে আবদ্ধ ব্রাহ্মণ বাঙালির জন্য লজ্জাতিলকের সমান। প্রেম যে অন্ধ– তা ধর্ম মানে না– সংস্কার মানে না– জাত মানে না।


এমনকি অগ্রাহ্য করেছে ভাষার সীমাবদ্ধতাকে। প্রেমের ক্ষেত্রে ভাষা কোনো বাধা নয়। মনে পড়ে সুদূর ল্যাটিন আমেরিকার পাওলো কোয়েলর আলকেমির কথা। কোয়েলো বলেছেন, পৃথিবীর সবকিছুর ভাষা আছে। এই মহাবিশ্বের ভাষা আছে। হৃদয় দিয়ে তা শুনতে হয়। ধীরাজ-মাথিন কি তাই শুনেছিল? একজন বাংলা বোঝে না; আরেকজন মগ বোঝে না। তবুও শুধু চোখাচোখিতেই প্রেম হয়ে যায়। কেউ কারও সাথে কোনোদিন কথা বলেনি– শুধু একজন আরেকজনকে দেখে এত ভালোবাসতে পারে!


মধ্যযুগের রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের মতো ধীরাজ-মাথিন প্রেমেরও একজন অনুঘটক ছিল। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের দ্যূত যেমন বড়ায়ি তেমনি ধীরাজ-মাথিনের প্রেমের অনুঘটক ছিল হরকির নামে এক বাঙালি বৌদ্ধ। 


যারা বইটি পড়বেন তাদের জন্য ধীরাজ-মাথিনের প্রেমের পরিণতিটা বলতে চাচ্ছি না। 


কলকাতার সদ্য এন্ট্রান্স পাস করা ধীরাজ ভট্টাচার্য শিক্ষক বাবার এক ছাত্র রতিলালবাবুর প্রচেষ্টায় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ আইবি( ইনভেস্টিগেশন ব্রাঞ্চে) যোগ দেন। আইবির তখন কাজ ছিল স্বদেশী আন্দোলনের নেতাদের ওপর নজরদারি করা। সেসব নজরদারির কৌতুকময় বর্ণনা আছে আত্মজীবনীমূলক বইটির প্রথম দিকে। পরে সারদা থেকে পুলিশ ট্রেনিং করে চট্টগ্রামে পোস্টিং হয়। সেখান থেকে এসপি মুলান্ডের সুপারিশে পার্মানেন্ট পোস্টিং হয় টেকনাফে। গান, নাটক, ছবি আঁকা প্রভৃতি গুণের পাশাপাশি একজন সুদর্শন সদালাপী স্মার্ট শহুরে যুবক ধীরাজ ভট্টাচার্য যে কারো কাছেই খুব দ্রূত প্রিয় পাত্র হয়ে যান। বেশিরভাগেরই ধারণা এই কোমলমতি ভদ্র শিক্ষিত মার্জিত সংস্কৃতিমনা তরুণ পুলিশের চাকরি করবে কী করে। তারপরে তাকে পোস্টিং দেয়া হয়েছে টেকনাফের মতো একটা সমস্যাসঙ্কুল জায়গায়। বঙ্গোপসাগরের উপচে পড়া ঢেউ আর সময়ে অসময়ে ঝড় জলোচ্ছ্বাসের কারণেই নয়, জায়গাটি বাঙালিবর্জিত এবং মেইনল্যান্ডের সাথে যোগাযোগের অনুপযোগী। বছরে ছয়মাস স্টিমার বন্ধ থাকে। 


পুলিশের কাজে তাঁকে যেতে হয়েছে পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে বহু দুর্গম জায়গায়। সেই কাস্টমস কর্মকর্তা আব্দুল মজিদের সাথে লবণের আবগারি শুল্ক ফাঁকির ঘটনা তদন্ত করতে নীলা থেকে বহুদূরে বুনহাতি, বাঘ আর সাপ-সঙ্কুল পাহাড় জঙ্গল পাড়ি দিয়ে মরিআলা গ্রামে। দারিদ্র্য-দুর্দশাক্লিষ্ট মানুষের সমুদ্রের পানি ফুটিয়ে লবণ উৎপাদন এবং বিক্রি করে সারাদিনে একবার আহার জুটাতে না পারা মানুষের কষ্ট দেখে মজিদ সাহেব নিজেই কান্না করে ফেলেন। তবুও দায়িত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে অপরাধীকে ধরে আনেন ঠিকই। কিন্তু অপরাধীর ছেলে-মেয়ের অনাহারাশঙ্কায় দুটি টাকা দিয়ে আসেন। আর জরিমানার দশ টাকাও নিজের পকেট থেকে দিয়ে বাঁচিয়ে দেন অপরাধীকে। ধীরাজ ভট্টাচার্য মজিদের ভিতর এক অন্যরকম মানুষ দেখতে পেয়ে অভিভূত হয়ে যান। 


মজিদকে নীলাতে ছেড়ে টেকনাফে ফিরে আসেন ধীরাজ। তারপর আর একদিনের বেশি থাকা সম্ভব হয়নি তাঁর। ওইদিনই ঝড় জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে স্টিমার টেকনাফ ছেড়ে চট্টগ্রামে যাবে। সমাজ-সংস্কার, ধর্ম আর পিতৃস্নেহের কাছে পরাজিত ধীরাজ সেই ঝড়ঝঞ্জার মধ্যেই চলে আসেন টেকনাফ থেকে। না পালিয়ে আসেন?


টেকনাফে মাথিনের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা আর তাৎক্ষণিক জানা সম্ভব হয়নি। পরে ফিল্মে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করার দ্বিতীয় দিনের শ্যুটিংয়ে টেকনাফ থেকে সহকর্মী যতীনের চিঠি পান ধীরাজ। 


চিঠিতে কী এমন ছিল যা তাঁকে ক্রমাগত কাপুরুষ কাপুরুষ করে ধিক্কার দিয়েছে? এইটুকু বলে দিলে পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। 


"যখন পুলিশ ছিলাম" বইটি আত্মজীবনীমূলক হলেও বাংলাসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। টেকনাফ থেকে নীলা হয়ে মরিআলি গ্রামে যাওয়ার বনজঙ্গলের যে বর্ণনা তা বিভূতিভূষণের "আরণ্যক" উপন্যাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। আর রাত্রিকালীন পাহাড়ের বর্ণনা মনে করিয়ে দেয় বিভূতিভূষণেরই "চাঁদের পাহাড়ের" কথা। 


বইটি যদি কেউ চাকরি পাওয়ার আগে পড়ে তবে তার পুলিশ হওয়ার ইচ্ছা জাগবে। আর সে যদি এডভেঞ্চারাস হয় তাহলে পোস্টিং বেছে নেবে টেকনাফে।  সহজ-সরল গদ্যে লেখা বইটি এক বসাতে পড়ে ফেলতে পারেন। পড়ার পরে আপনার ভিতরে দুমড়েমুচড়ে যেতে পারে।

Post a Comment

0 Comments